ঠিকানাহীন চিঠি - ৯
প্রিয়তমা,
তুমি খুবই ভালো আছো, জানি - তাই অকারণ ‘কেমন আছো’-র কেঠো ও কেজো ফর্মালিটি করতে পারছি না। ভালো থাকবে না-ই বা কেন? আমার শীতল সত্তার রুক্ষ স্পর্শ তোমার আলোঝলমলে জীবনকে এখনো অভিশপ্ত করে তুলতে পারেনি। মেডুসা-হেন এই উপস্থিতি যে কতটা অসহ্য, কাউকে যদি বোঝাতে পারতাম! কেউ বিন্দুমাত্র কাছে আসতে চাইলেই মনে হয় নিজের দু’চোখ চাপা দিয়ে চিৎকার করে বলি, “পালিয়ে যাও, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়!” যাইহোক, সেই দুর্ভাগ্য তোমার যেহেতু এখনো হয়ে ওঠেনি, এবং অদূরেও হবে বলে বোধ হয় না - তাই, আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, তুমি ভালোই আছো। আর, ভালো থাকারই তো সময় এটা!
বিধাতাপুরুষও কী অদ্ভুত ও বিচিত্র সব কাজ করেন, না? মাঝেমধ্যে আমাদের ছোটোছোটো ক্রীড়নকের মতো তুলে ধরে এখানেওখানে বসিয়ে দেন; একজনের পথের বাঁকে, জীবনের পাকদণ্ডীতে অন্য আরেকজনকে এনে বসিয়ে দেন - দিয়ে অলক্ষ্যে মিচকি হাসতে থাকেন, আর আমরা ভাবি অদৃষ্ট, সমাপতন। আমাদের কোনোভাবেই কি কোনোদিন দেখা হওয়ার কথা ছিলো, নাকি আলাপ হওয়ার কথা ছিলো? ব্যাপারটা কতোখানি অসম্ভব, সেটা একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝবে আশা করি। কিন্তু তাও, যেহেতু কল্পগল্পকে বাস্তবের ঘটনা বরাবরই দশ গোল দিয়ে এসেছে, তাই এই অসম্ভবও সম্ভব হয়ে উঠেছিলো৷ আমাদের কথা হলো, দেখা হলো, চেনা হলো - বা, সত্যিই কি আমরা একে অপরকে জানতে পারি? জানতে পেরেছি কোনোদিন? যার সঙ্গে দীর্ঘদীর্ঘকাল সময় কাটিয়েছি, তাকেও আজকাল ভীষণ, ভীষণ অচেনা লাগে - যেন কোনোদিন মুখ ছুঁয়ে দেখিনি আমরা, মুখোশের ভিড়েই শুধু হাত বুলিয়েছি। রবি ঠাকুরের মতো বলতে পারলে ভালোই হতো,
“তোর সাথে চেনা
সহজে হবে না,
কানে কানে মৃদুকণ্ঠে নয়।
করে নেব জয়
সংশয়কুণ্ঠিত তাের বাণী;
দৃপ্ত বলে লব টানি
শঙ্কা হতে, লজ্জা হতে, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হতে
নির্দয় আলােতে।”
মুশকিল হচ্ছে, এতো জোর আমার কারোর উপরেই খাটে না - তোমার উপরে তো আরোই খাটাতে পারবো না। জোর খাটানোর জন্য অধিকারবোধের প্রয়োজন, অধিকারবোধের জন্য সমর্পণের। সমর্পণ করতে পারি, তুমি তো গ্রহণে সক্ষম নও! নেওয়ার মতো দুঃসাহস তুমি দেখাবেও না, এবং সত্যি বলতে কি, তা কাম্যও নয়।
কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হলে মনে হয়, হয়তো দেখা না হলেই ভালো ছিলো৷ অনস্তিত্বের অতলে তারা কোথায় ডুবে থাকতো, আমরা উপরিতল থেকে টেরটুকুও পেতাম না। দেখা হলেই বিপদ - একে ভোলাও যায় না, ফেলাও যায় না - মনে হয়, এতো জটিলতা থেকে কোথাও ছুট্টে পালিয়ে যাই, কিন্তু উপায় নাস্তি। পালানোর উপায় নেই৷ সবসময়ে রুখে দাঁড়াতেই হবে, চোখে চোখ রেখে মোকাবিলা করতে হবে। কিচ্ছু করার নেই। তোমার সঙ্গেও যদি কোনোদিন পরিচয় না হতো, তাহলে দুজনের জন্যই ভালো হতো। আমার অস্তিত্বও তোমাকে বিচলিত করতো না, তোমার উপস্থিতিতেও আমার ভিতর উথালপাতাল হতো না। আমারও অবস্থা দেখো, ক্রমাগত অবহেলা-উপেক্ষা সহ্য করেও নতজানু হয়ে বসেছি মাথা পেতে, কিছু পাবো না জেনেও। না পেতে পেতে সেটাই আসলে অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আবারও, যদি পেয়েও যেতাম, সেটা আবার তোমার জন্য মঙ্গল হতো না।
জানিনা কতোটা বোঝাতে পারলাম, কী বোঝাতে পারলাম, বা আদৌ কিছু বোঝাতে পারলাম কিনা। যদিও আমার বোঝানোর কোনো দায় অন্তত নেই, তবে তুমি একটুও যদি অনুভব করতে পারো, তাহলেই সার্থক মনে করবো।
প্রসঙ্গত, আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ ও সাহিত্যিক, বুদ্ধদেব গুহ তাঁর ‘হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসে একটা কথা লিখেছিলেন - আমার বক্তব্যকে এর থেকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা আমার নিজের পক্ষেও সম্ভব হতো না।
“আমার অশেষ আর্তি তার সুখকে কোনোদিনও যেন বিঘ্নিত না করে।’’
ভালো থেকো। সুখে থেকো, স্বস্তিতে থেকো। তোমার অন্তহীন অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি,
…..
Comments
Post a Comment