সব খেলার সেরা...

আপনারা কোনোদিন ফুটবল খেলেছেন? নির্ঘাত খেলেছেন। জীবনে ফুটে বল ছোঁয়ায়নি, এমন কূট কাজ কেউ করেছে বলে তো মনে হয় না - আর, ফুটবল খেলেনি, এমনটাও মুখ ফুটে বলে না কেউ। আমিও একবার ফুটবল খেলে ফেলেছিলাম স্কুলে থাকাকালীন, সেই ঘটনাই বলার।


আমি ছোটো থেকেই একটু গোলগাল গোছের, তেমন মারকুটে নই - যাকে লালু ছেলে বলে আরকী। তবে লালু ছেলে হলেও স্বভাবে শরৎচন্দ্রের লালুর মতো ছিলাম - যারজন্য কপালে বরাবর অর্ধচন্দ্র জুটেছে, লালু হওয়ার ফলে তালুতে গজিয়েছে আলু। খেলাধুলোতেও চালু ছিলাম, ক্রিকেট বিশেষ করে। কিন্তু ফুটবলটাকে ম্যানেজ দিতে পারতাম না - কোনো এজেই ম্যান-সুলভ (দয়া করে জেন্ডার ন্যারেটিভ আনবেন না, আনার আগে একবার বাংলা মিডিয়াম বয়েজ স্কুলে ফুটবল খেলে নেওয়ার অনুরোধ জানাবো) ভাবে খেলাটাকে edge করতে পারিনি, গেঁজেই গেছে বরাবর। ফুটবল বরাবরই তাই আমার কাছে ঝুটবল হয়েই থেকে গেছে - এক্কেবারে ঝুটো হয়ে, দুটো বার খেলার কথাও ভাবিনি। 


ভাগ্যের ফেরে একদিন আমাকেও যদিও পথে, মানে মাঠে নামতে হলো৷ 


তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সে এক ভয়াবহ সময়। ঠোঁটের ডগায় গুম্ফ আর জীবনে লম্ফঝম্প, দুইই সমানভাবে লাফাতে ঝাঁপাতে আসছিলো। যে বয়েসটায় হঠাৎ করে বেড়ে যায় লোকে, কাপড়চোপড় বেমানান হয়ে যায়, গলা ভাঙতে থাকে - সেই লিবার্টিচাওয়া পিউবার্টির বয়েস আমার তখন। স্কুলে যাই, প্রবল পেঁয়াজি মারি, সব স্যারেরা আমাকে কাসভের মতো পিটিয়ে রাসভ থেকে ঘোড়া বানাতে অপারগ হয়ে মনের দুঃখে আসবাসক্ত হয়ে পড়েছেন - যা সব অবস্থা! 


এরকমই এক সময়, স্কুলে ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে। ইন্টারক্লাস টুর্নামেন্ট, ফার্স্টক্লাস খেলা - ফার্স্ট ক্লাসের পরেই সবাই বল হাতে, থুড়ি বল পায়ে নেমে পড়ছে। 


সেদিন সেমিফাইনাল খেলা ছিলো নাইনের সঙ্গে ইলেভেনের। মার্কিনদের কাছে তা যেমন দুঃস্বপ্নের মতো, আমাদের কাছেও তাই - ইলেভেনের দলটা স্কুলের মধ্যে সেরা ছিলো। নিজে নাই খেলি, ক্লাসের জন্য অন্তত চিয়ার-আপ ইত্যাদি করার কাজটা সানন্দে করতাম, সোৎসাহে করতাম, আর ক্লাস হেরে গেলে মন খারাপ হতো খুব, একদম ভাল্লাগতো না। খুবই ডিক্লাসড লাগতো, ক্লাস্টার্ড হয়ে যেতাম। ফলে, খুবই চিন্তার বিষয়ে। ইলেভেনের টিমে ছিলো দুঁদে স্ট্রাইকার গৌতমদা - আন্ডার-১৯ খেলে ময়দানে। মোহনবাগানের হয়ে নিয়মিত খেলছে। দুপায়ে অনবদ্য শট, তেমনই দুরন্ত গেমসেন্স। তার সঙ্গে মানানসই উইঙ্গার কালামদা আর সুপ্রিয়দা - উইং দিয়ে বাঘের মতো দৌড়ে কখন যে সুইং করে ঢুকে যাবে, বলা মুশকিল। মাঝমাঠও প্রশংসনীয়। ডিফেন্সে বেঁটে, গাঁট্টাগোঁট্টা সেন্টারহাফ আকাশদা - মাছিও ওর কাছে পারমিশন চেয়ে নেয় গলে যাওয়ার আগে; আর লেফটব্যাক সাজিদদা। চোরাগোপ্তা মারে সিদ্ধহস্ত, বা সিদ্ধপদ - কেরদানি মারতে গেলে বিচ্ছিরি ট্যাকল করবে, হেকলও। আর গোলে প্রায় সাড়ে ছ'ফুট লম্বা চিত্তদা - শুটআউটেও পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব বল সামলে দিতো। চিত্তদা গোলে দাঁড়ানো, আর বল দেওয়ালে মারা প্রায় সমার্থক। 


এই ভীতিপ্রদ লাইনাপের বিরুদ্ধে আমাদের যে টিম নামবে, তারা মোটামুটি বাতাবিলেবু দিয়ে খেলার যোগ্য - আমাদের সেন্টার ফরওয়ার্ড সৃজন একেবারেই বিশ্রীজন - ডাচ টোটাল ফুটবলের ন্যায় সে সব পজিশনেই খেলতে থাকে, নিজের বাদে। সৃজন পকেটে করে গ্লাভস নিয়ে আসে কিনা, যাতে হঠাৎ মাঠের মধ্যেই পরে নিয়ে গোলে একটু দাঁড়িয়ে নেবে কিনা - এই নিয়ে আমরা খুবই সন্দেহপ্রকাশ করতাম। আমাদের দুটো উইং তথৈবচ, রেডবুল খেলে যদি উইং ফিরে পাওয়া যায়; মাঝমাঠে অর্ক আর সায়ন সেন্টার মিডফিল্ডে নিজেদের মধ্যেই মারামারি করে হলুদ কার্ড খায়; রাইটব্যাকে শুভ, যে অপোনেন্টের স্ট্রাইকার দেখলেই আরো ব্যাকে পিছোতে পিছোতে গোলের পিছনে চলে যায়। একমাত্র ভরসা আমাদের ক্যাপ্টেন বিশ্ব, সেন্টারহাফ। গোলকিপার প্রমথ অলিভার কানের ভক্ত, কিন্তু অলিভারের চোখ পায়নি। আর, অদ্ভুত ভাবে, প্রমথ প্রতিবার হিসেব করে শটের ঠিক বিপরীতে ঝাঁপাতো। ওকে অনেকেই আমরা বুঝিয়েছিলাম, গেম থিওরির মতো হিসেব কষে উল্টোদিকে ঝাঁপাতে - মানে, ডানদিকে ঝাঁপাতে ইচ্ছে হলে বাঁদিকে ঝাঁপাতে, বা ভাইসি-ভার্সা। প্রতিবারই ও ঘাড় নাড়তো, আর ঠিক একই জিনিস করতো। ম্যাচের পর গালাগাল খেলে দেঁতো হাসি হেসে বলতো, ‘'আহা, আমার গুলিয়ে যায়। ফুটবল তো আসলে ভাগ্যের খেলা…” 


এই দুর্মদ টিম যে কীভাবে সেমিফাইনালে গেলো, সেটা আমরা যেমন জানি না, যারা খেলছে, তারাও জানে না। 


যাইহোক, খেলার দিন, আমরা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে। খেলা তখনো শুরু হয়নি। রেফারি বাংলা স্যার, লাইন্সম্যান আরেক বাংলা স্যার আর অ্যাকাউন্টেন্সি স্যার - ওঁরা আস্তে আস্তে আসছেন। বাকি স্যারেরাও মোটামুটি এসে জড়ো হচ্ছেন একে একে। 


এমনসময়ে আমাদের ক্যাপ্টেন বিশ্ব দেখলাম মাঠের এক কোণের বারান্দা থেকে (ওটাই ড্রেসিংরুম ছিলো) চিন্তিত মুখে এগিয়ে আসছে। বিশ্বের ওরকম রূপ, বিশ্বরূপ দেখে চিন্তিত হলাম। 


“কী হয়েছে ভাই?”


“বলিস না আর। জনির পা মচকেছে। হতচ্ছাড়াকে কতোবার বলেছি, খালি পায়ে কাদার মধ্যে নাচানাচি করবি না। ইডিয়ট!”


জনি আমাদের লেফটব্যাক। খুব ভালো খেলে না, তবে মাঝে মাঝে সুন্দর ক্লিয়ার করে দেয়। আর সমস্যা হলো, আমাদের সাবস্টিটিউট রেডি নেই তখন।


“তাহলে? এবার কী করবি?”


আমাদের চিন্তিত প্রশ্ন। 


“এই অর্চি, তুই তো দেখি রোজই ফুটবলের নামে বোতল লাথাস। একটু উদ্ধার করে দে বাপ!” বিশ্বের নিঃস্ব হাহাকার!


দুটো হেঁচকি উঠলো আমার। জীবনে বলে পা ছোঁয়াইনি - তখনো আমি নাবালক, এবং না-বালাকও বটে। চালাকও নই। এই ভয়াবহ গুরুদায়িত্ব আমাকে কেন! অনেকেই তো আছে!


এসব ভেবে কাঁচুমাঁচু মুখে বললাম, “ইয়ে মানে, ভাই, আমাকেই কেন? আমার আজকে পেটটা, ইয়ে মানে…”


“কোনো ইয়েটিয়ে না। তোর ঘাড় খেলবে! জনির একসেট কিট আছে, চুপচাপ পরে ফ্যাল।”


আমার অবস্থা তখন বলির পাঁঠার মতো৷ তারমধ্যে হতচ্ছাড়া বন্ধুগুলো পাশ থেকে আওয়াজ দিচ্ছে, “ভাই, নেমে যা। পাশে আছি!”


সে অভিমন্যুর পাশেও ভীম ছিলো - কিন্তু তারপর কী হইলো, জানে শ্যামলাল - মনে মনে ভাবি আমি। ভাবী দুরবস্থা কল্পনা করে অল্প না, বেশ চিন্তিত হলাম।


বিশ্ব এক ধাক্কা মেরে ঠেলে দিলো। 

“দশ মিনিটে ম্যাচ শুরু। নাটকবাজি পরে হবে। এখন নাম, পরে দেখছি কী করা যায়। ড্রেস আপ!”


গুটি গুটি পায়ে ড্রেসিংরুমে, মানে বারান্দায় উঠলাম। জার্সি গলিয়ে দেখি, সেই জার্সির মধ্যে হাসতে হাসতে আরো একটা আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। জনি লম্বা এবং বেশ পৃথুলও। 


“ভাই, জার্সি বড়ো হচ্ছে!” আমার মার্সি ভিক্ষা বিশ্বের কাছে। 


“তা তুমি কি বাপের বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছো নাকি? ওঁকে আবার মাপমতো জার্সি দিতে হবে, তাতে সোনার বোতাম দিতে হবে! চুপচাপ পরে ফ্যাল!”


অগত্যা। ঢোলা জার্সি পরে, পায়ে স্পাইক এঁটে, শিনগার্ড ইত্যাদি পরে কোনোমতে তৈরি হয়ে বধ্যভূমি, থুড়ি, মাঠের দিকে এগোলাম। তারমধ্যে মাঠ কাদায় কাদা। বর্ষাকাল, প্যাচপেচে দশা পুরো। কাদা দেখে কাঁদা উচিত কিনা, এটাই ভাবছিলাম।


রেফারি স্যার মারাত্মক মারকুটে লোক। ক্লাসে তো বটেই, ভুলচুক হলে মাঠেই পিটিয়ে দিতেন। স্যার দেখলাম ঘড়ি দেখছেন আর কটমটে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমাকে দেখে স্যার ঘাবড়ে গেলেন।


“অ্যাঁ? তুই খেলবি? ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? তাও চশমা পরে?”


আমি কিছু বলার আগেই বিশ্ব আমাকে হাঁটু দিয়ে এক গুঁতো মারলো। ফলে ঠিক উত্তর না বেরিয়ে মুখ থেকে শুধু “কোঁক” করে একটা আওয়াজ বেরোলো। 


“কোঁক মানে?”


“ও কিছু না স্যার। ওর একটু হেঁচকির সমস্যা আছে। আসলে স্যার, জনির তো পা মচকেছে। ওকেই নামাচ্ছি তাই। পেলাম না তেমন কাউকে। আসেওনি কেউ আজ বিশেষ।”


স্যার আর বিশেষ কিছু বললেন না। গম্ভীর ভাবে “হুম!” বলে চলে গেলেন। 


বিশ্ব আর গৌতমদা টস করলো। গৌতমদা টসে জিতে সেন্টার নিলো। 


বিশ্ব আমাদের ডাকলো। 


“ভাই, এই ম্যাচ জিততেই হবে। জানি, ওরা ভালো, তবে আমরা চেষ্টা করলেই পারি। আমরা কি পারি না, আমাদের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনতে, নিজেদেরকে প্রমাণ করতে, দেখিয়ে দিতে যে নাইনও পারে - নাইন মানেই শুধু জার্মান ‘নাইন’ নয়, তা সুপারফাইনও হতে পারে? বল, আমরা কি পারিনা নিজেদের একটা পরিচিতি পৃথিবীর - মানে, দেশের - ধুত্তোর, মানে স্কুলের মধ্যে রেখে যেতে?”


বিশ্বের চোখ ছলছল করছে। অর্ক আর সৃজন প্রায় কেঁদেই ফেললো। আমিও কাঁদবো কিনা, মানে বিশ্বের কথায় না নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে, ভাবতে ভাবতে ‘ফ্যাঁচ’ করে হেঁচে ফেললাম।


সবাই কটমট করে তাকালো। বিশ্ব আমাদের বললো, “শোন, জনির জায়গাটায় অর্চি এক্স্যাক্টলি খেলিস না। আমি রাইট ব্যাক খেলছি। অর্চি সিডিএমে (সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড) খেল। তোর কাজ হলো ওরা বল নিয়ে মিডফিল্ড থেকে উঠতে গেলেই শুধু বল ক্লিয়ার করা, আর বল পায়ে পেলে শুধু পাস করে দেওয়া। তোকে বিশেষ কিছু করতে হবেনা। শুধু ভালো করে ক্লিয়ার করিস।”


আমি বাধ্য পাঁঠার ন্যায় ঘাড় নাড়লাম।


বিশ্ব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে আর কী। চল। আর শুভ, তুই যদি আজ পিছিয়েছিস, তোকে আমি গুছিয়ে ক্যালাবো। সুপ্রিয় বা গৌতম তোর দিকে ঢুকলে তুই শুধু ক্লিয়ার কর, বাকি ওদের দেখে নেবো আমি।”


শুভ ক্লিয়ার করার পরে বিশ্ব আর কী দেখবে, বুঝতে পারলাম না। শুভও বোঝেনি নির্ঘাত। সে টক করে ঘাড় নেড়ে দিলো।


“আর প্রমথ, তুই আজকে যদি উল্টোদিকে লাফিয়েছিস, তোর উপর আমি লাফাবো স্পাইক পরে।”


এসব জটিল আলোচনার শেষে আমরা পজিশন নিলাম। কিক-অফের বাঁশি বাজলো।


সেন্টার হলো বল। আমি বক্সের একটু উপরে কচ্ছপ - নট-নড়নচড়ন। এমনিতেও ওই ঢোলা জার্সি, শিনগার্ড, স্পাইক ইত্যাদি পরে মধ্যযুগীয় নাইট লাগছে নিজেকে - ফাইট দিতে পারবো কিনা, সেটাই বুঝতে পারছিনা। 


মাঝমাঠে লাথালাথি হচ্ছে। হঠাৎ বল নিয়ে তড়িৎ বেগে উঠলো তড়িৎ দা, ইলেভেনের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। একেবারে গরিবের ইনিয়েস্তা। তড়িদাহত আমি বুঝতে পারলাম, বলটা এদিকেই আসবে। পেটটা কেমন মুচড়ে উঠলো।


“অর্চি ক্লিয়ার!”


ডাক শুনে হঠাৎ চেগে গিয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তড়িৎদার দিকে দৌড় দিলাম এক হুঙ্কার তুলে। 


তড়িৎদা ঘাবড়ে গেলো হঠাৎ। ওরকম একটা জার্সি দৌড়ে আসছে মুখচোখ বিকৃত করে, হাঁক পাড়তে পাড়তে - সে যে কী ভয়াবহ দৃশ্য… তড়িৎ দা টেম্পোরারিলি টেম্পোতে ভুল করে ফেললো, আর বলটা দেখলাম সামনে লাউ গড়্গড় করছে। দিলাম জয় মা বলে পা চালিয়ে। বল উড়ে গেলো মাঠের বাইরে। থ্রো। 


“শাব্বাশ ভাই, দারুণ ক্লিয়ারেন্স!”


উচ্ছ্বসিত চিৎকার ভেসে এলো। নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারলাম না। সেকী, আমি ক্লিয়ার করেছি? আমি? বোতলপেটানো আমি কিনা স্কুলের ইনিয়েস্তা তড়িৎদাকে নাস্তানাবুদ করে দিলাম? 


আত্মপ্রসাদে মন ভরে উঠলো। 


সেই আত্মপ্রসাদ বেশিক্ষণ টিকলো না যদিও। কিছুক্ষণের মধ্যেই বল নিয়ে দেখি গৌতমদা ঢুকছে আমাদের হাফে। দেখেই আমার সমস্ত বলভরসা শুকিয়ে গেলো৷ আমাদের দুই মিডফিল্ডার অর্ক আর সায়নকে যেভাবে হেলায় কাটিয়ে খেলায় মুগ্ধ করে আমার দিকে বল নিয়ে এগোলো, আমি ডিফেন্ড করবো নাকি অটোগ্রাফ নেবো - এই দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। শেষমেশ ডিফেন্ড করাই শ্রেয়, এই ভেবে কায়দাবাজি মেরে স্লাইড ট্যাকল করতে গেলাম। কাদা ভরা মাঠ - স্লাইড করতে অসুবিধে হলো না। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যেভাবে এসজিপিএ মসৃণভাবে পিছলে নিচে চলে গেছিলো, ঠিক ওরকমই পিছলে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো ট্যাকলে। স্লাইডের চোটে গৌতমদাকে টপকে সোজা গিয়ে লাথি মারলাম লাইনসম্যান অ্যাকাউন্টেন্সি স্যারকে। স্যার মুখ দিয়ে “ঘুঁরুৎ” করে একটা আওয়াজ করে পড়ে গেলেন। সেই কাজের অ্যাকাউন্টেবিলিটি নেওয়ার আগেই দেখলাম, গৌতমদা আমাদের বক্সে। অদ্ভুত কায়দায় বিশ্বকে একটা হাফটার্নে কাটিয়ে, প্রমথর মাথার উপর দিয়ে লব করে পোস্টের হরে ভ'রে দিলো। 


“গো-ও-ও-ও..” চিৎকার উঠলো। 


কিন্তু না। ওল নয়, কচু। ওদিকের লাইন্সম্যান পতাকা তুলেছেন। ওদের একজন অফসাইড ছিলো। উফ, নিশ্চিন্দি! 


হঠাৎই চুলের মুঠি ধরে দেখি কে ঝাঁকাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, অ্যাকাউন্টেন্সি স্যার। আমি ওঁকে লাথি মেরে ধরাশায়ী করে ওঁর গায়েই হেলান দিয়ে বসে খেলা দেখছিলাম। খেয়াল হতেই লাফিয়ে দাঁড়ালাম। স্যার রোষকষায়িত নয়নে একবার তাকিয়ে আর কিছু বললেন না। 


তারপরে শুরু হলো পুরো ধ্বস্তাধ্বস্তি খেলা। খেলা হচ্ছে পুরো আমাদের হাফে। হাঁফিয়ে যাচ্ছি আমরা। ওদিকের গোলে দেখি, চিত্তদা বারের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে, ধন্যি মেয়ে সিনেমার ঘণ্টার মতো, আর এদিকে গোলে হরিবোল। 


শেষমেশ বাঁশি বাজলো। হাফটাইম। 


ড্রেসিংরুমে, থুড়ি ড্রেসিংবারান্দায় একটা খণ্ডযুদ্ধ লেগে গেছে দেখি অর্ক আর সায়নের মধ্যে। কী? না, অর্ক সায়নকে কখন যেন ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে, তাই অর্ক নাকি বল নিয়ে উঠতে পারেনি।


“তুই আমাকে আটকালি কেন? ল্যাং মারবি আমাকে? দেখতে পাস না?”


“চুপ কর তো! খেলতে পারে না! আমি ট্যাকল করতে গেছি ওদের ওই তড়িৎকে, তুই ওরকম মাঝপথে চলে আসবি কেন উজবুক?”


“তোর বাবা উজবুক!”


“তবে রে..”


একটা শুম্ভনিশুম্ভ লেগে গেলো। বিশ্ব দৌড়ে এসে আলাদা করলো ওদের৷ 


“কী হচ্ছে এগুলো? ইয়ার্কি হচ্ছে? আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে এসেছি? আমরা জিতবো না? পারবো না আমরা জিততে? এই টুর্নামেন্ট আমাদের জিততেই হবে। এটা নিজেদের কাছে নিজেদের লড়াই একটা। অনেক অবহেলা, অপমান সহ্য করে, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া কিছু মানুষ আমরা নিজেদের শেষ রক্তবিন্দুটুকু নিংড়ে দেবো বলে নেমেছি। এখানে তোরা মারামারি করে…”


গলা ধ'রে এলো বিশ্বর। কিন্তু বিশ্ব যে ক্লাস নাইনে কোন জীবনযুদ্ধে হেরেছে, বুঝলাম না। বিশ্বর বাবা ডাক্তার, মা প্রফেসর। আনন্দপুরী অঞ্চলে বিশাল তিনতলা বাড়ি, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর যারা খেলছি, তারাও অনেকেই মোটামুটি সচ্ছ্বল ঘরের৷ কোন জীবনযুদ্ধে বিশ্ব হেরে নিঃস্ব হয়ে গেছে, জানতে ইচ্ছে হলো - কিন্তু চুপ করে গেলাম। আবেগের কোনো অভিধান নেই ইত্যাদি। 


বিশ্ব আমার পিঠ চাপড়ে দিলো। “শাব্বাশ, ভালোই তো খেলেছিস! আর ৩৫ মিনিট ভাই। পারবি তুই!”


আমার বুক তখন হাপরের মতো উঠছে-নামছে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ৷ লাইন্সম্যানকে ল্যাং মারা আর তড়িৎদার ঠ্যাং থেকে বল ক্লিয়ার করা বাদে কী করলাম, বুঝিনি। যাইহোক। 


হাফটাইম শেষ হলো। গ্লুকনডি ইত্যাদি খেয়ে, মুখেচোখে জল দিয়ে নামলাম আবার। এবার হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। তারমধ্যে বিশ্ব আবার আমাদের ডেকে একটা ভাষণ দিলো -


“কমরেডস, আমাদের আজ বীরের মতো এগোতে হবে। গভর্নমেন্ট স্কুলের ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। লেডি এমিলি ইডেন, ডঃ ভোলানাথ বসুর পদধন্য এই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, তাতে আমরা বিরোধীদের অনুপ্রবেশ মেনে নেবো না। অনেক সংগ্রামের ফল আমাদের এই বিদ্যালয়, এই মাঠ, এই ক্লাস নাইন। এই বিদ্যালয় আমাদের মা, আর আমাদের মা আজ অন্য কারোর করায়ত্ত। আমরা পারবো না, আমাদের মা-কে ফিরিয়ে আনতে?”


বিশ্বর গলা কাঁপতে থাকে। পাছে আরো কিছু বলে, আমরা তাই তাড়াতাড়ি পজিশন নিলাম আবার।


পিঁইইইইপ…


বাঁশি বাজলো। কিক-অফ। আমি দাঁড়িয়ে চুইংগাম চিবুচ্ছি। হঠাৎ দেখি, আমাদের দল প্রায় ওদিকের হাফে। আমাকে শুভ দৌড়ে এসে ডাকলো, “ভাই, ওদিকেই তো সবাই৷ চ’ ঘুরে আসি!”


ভাবখানা এমন, যেন পুজোর সময়ে হোলনাইট ঘুরে ক্লান্ত, এবার একটু ম্যাডক্সে গিয়ে বসে আসি!


দুজনে দৌড় দিলাম। ওদিকের হাফে তখন ষাঁড়াষাঁড়ি বানের মতো মারামারি হচ্ছে৷ গোল না দিলেই বিশ্বর ভয়াবহ বক্তৃতা শুনতে হবে - ফলে সবাই জানপ্রাণ লাগিয়ে দিচ্ছে।


আমি গোলমালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম৷ পুরো পানিপথের যুদ্ধ চলছে - মাঠের পথে পানিকাদায় ভর্তি এমনিও।


হঠাৎই অর্ক বল কাটিয়ে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো উইং ধরে। আমার কী মনে হলো - আমিও পাশাপাশি ছুটতে থাকলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখি, সবাই ছুটছে আমাদের সঙ্গে - সৃজন দৌড়োচ্ছে, বিশ্ব দৌড়োচ্ছে, শুভ দৌড়োচ্ছে, সায়ন দৌড়োচ্ছে, পিছনে দেখি আমাদের প্রমথ গোল ছেড়ে উঠে এসে ও-ও দৌড়োচ্ছে। দেখেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। এ কে রে ভাই! এমনকী, আমাদের সঙ্গে রেফারিও দৌড়োচ্ছে। দেখে মনে ভারি পুলক হলো। 


অর্ক উইং ধরে বল নিয়ে দৌড়ে একটা অদ্ভুত সুন্দর ক্রস তুললো। ক্রসের পিছনে দৌড়োতে গেছি, হঠাৎই দেখি পাশে সৃজন “ঘঁচাৎ” করে একটা আওয়াজ করে বসে পড়লো। সাজিদদার ক্লিন ট্যাকল। 


রেফারির বাঁশি। ফ্রি-কিক। 


আমাদের ফ্রি-কিক নিতো বিশ্ব। বিশ্ব এগিয়ে এলো। ওদিক থেকে সৃজনকে ডাকলো - দুজনে কানে কানে কী আলোচনা করে নিলো। পরে শুনেছিলাম, সৃজন মারতে এসে লাফিয়ে যাবে, আর বিশ্ব শট নেবে - এই হয়েছিলো আলোচনা।


হঠাৎ দেখি, সৃজন দৌড়ে এসে দমাস করে ওয়ালে মেরে দিলো, ডিফ্লেক্ট হয়ে আমাদের কার একটা পায়ে লেগে গোল কিক। 


পিছনে তাকিয়ে দেখি, বিশ্ব সৃজনের গলা ধরে বুকে বসে পড়েছে।


“হতচ্ছাড়া (ছাপার অযোগ্য) ইয়ার্কি মারিস? বললাম এতো করে, কথাবার্তা কি (ছাপার অযোগ্য) ঢুকিয়ে রাখিস?”


বিশাল কেলেঙ্কারি কেস৷ আমরা সবাই গিয়ে ওদের আলাদা করলাম। রেফারি দুজনকেই একটা বেত দিয়ে দুঘা সপাসপ বেতিয়ে দিলেন, আর চেতিয়ে দিলেন যাতে এরকম আর না হয়। সৃজন বেচারা, কিছু না করেও বেতের মার খেয়ে গেলো৷ 


গোলকিক হয়ে আবার খেলা শুরু। 


খেলা আমাদের হাফে আবার। জগতের যা নিয়ম। মারাত্মক প্রেসিং ফুটবল খেলছে ইলেভেন৷ কোনোমতে সামাল দিচ্ছি আমরা। তারমধ্যে ধপাধপ কাদায় আছাড় খেয়ে নীল-সাদা জার্সি ধূসর-সবুজ হয়ে গেছে। মাথাটাথা ঘুরছে।


হঠাৎ দেখি আমার সামনে বল। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে লাথি চালালাম৷ লাথি চালাবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি, ওদের লেফটব্যাক সাজিদদা ‘উরে মারে, মরে গেছি রে’ করে ঠ্যাং ধরে লাফাচ্ছে। কী ব্যাপার? 


রেফারি খেলা থামিয়ে দৌড়ে এলো। দেখি, বলে লাথি মারতে গিয়ে সাজিদদার জুতোয় জুত করে লাথি মেরে দিয়েছি - আর সাজিদদার পা মচকে গেছে। ধরাধরি করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো বাইরে। আমাকে স্যার হলুদ কার্ড দেখালেন, আর আমার কানকে লালকার্ড - মানে কান মলে লাল করে দিলেন। সে ঠিক আছে। ওদের জাঁদরেল ব্যাককে তো অন্তত গ্যালারি (মানে বারান্দা)-তে ব্যাক করালাম! 


মাঠজুড়ে আমার নামে উচ্ছ্বাসধ্বনি। কয়েকজন দর্শক মেক্সিকান ওয়েভ করার একটা চেষ্টা করলো, সেটা কীরকম পুকুরে কাতলা মাছের ঘাই মারার মতো দেখালো।


আর ১০ মিনিট। কোনোমতে সামাল দিতে পারলেই.. চোখে প্রায় ধোঁয়া দেখছি। 


ইলেভেন আমাদের চেপে ধরেছে একেবারে। স্কুলের সেরা টিম, এরকম গোবেচারা টিমকে এখনো গোল দিতে পারেনি - যা হয় আরকী। এরমধ্যে হঠাৎ আমার কাছে সৃজন এলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে৷ 


“ভাই, এবার মালটাকে ছাড়বো না।”


আমার পিলে চমকে গেলো। কাকে ছাড়বে না? আমাকে? 


“অ্যাঁ? কেন?”


“শালা, কিছু করলাম না, তাও বেতের বাড়ি মারলো? আমাকে বিশ্ব ক্যালাচ্ছিলো, ওর দোষ, মার খেলাম আমি? এবার হয় এসপার নয় ওসপার!”


সৃজনের চোখ জিঘাংসায় পরিপূর্ণ। আমি প্রমাদ গুনলাম। 


বল নিয়ে উঠছে ওদের লেফট উইং কালামদা। ওদিকে সবাই ব্যস্ত। হঠাৎ সৃজন গিয়ে ট্যাকলের অছিলায় একটা ভয়ানক ট্যাকল করে রেফারিকে ফেলে দিলো। “ঘোঁক” করে একটা আওয়াজ করে রেফারি পা চেপে বসে পড়লো। 


“এবাবা স্যার, সরি সরি। পা পিছলে গেছে স্যার!”

সৃজনের মুখ দেখে কে বলবে, ও এতোক্ষণ ধরে এটার অপেক্ষায় ছিলো! স্যারকে একটা পেন্নামও করে ফেললো। ব্যথা পায়ে হাত দেওয়ায় স্যার আবার “ক্যাঁক” করে একটা আওয়াজ করে উঠলেন। স্যার তখন বিষ চোখে তাকিয়ে। কিন্তু সৃজনের অনুতপ্ত মুখ দেখে স্যারের বোধহয় দয়া হলো। কিন্তু স্যার আর দাঁড়াতে পারছেন না। কাঁধে হাত রেখে স্যারকে বেরিয়ে যেতে হলো। 


রেফারি ইনজিওর্ড। লাইন্সম্যান বাংলা স্যার রেফারি হয়ে নেমে পড়লেন। ওদিকে অ্যাকাউন্টেন্সির স্যার একাই লাইন্সম্যান।


আর ২ মিনিট…


হঠাৎই আমাদের টিম একটা অদ্ভুত মিসপাস ধরে ফেলে কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠে। ফাইনাল বাঁশি পড়বে পড়বে। ওদের গোলকিপার চিত্তদাও আমাদের হাফে - সে ঝটিতি দৌড় মেরেছে। এই আমাদের সুযোগ কনভার্ট করার। 


মাঝমাঠে ঢুকে গেছি আমি। হঠাৎই দমাস করে আছাড় খেলাম, চোখ থেকে চশমা গেলো ছিটকে। মাথা ফাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে, কানে তালা লেগে, চোখে অন্ধকার। কানা বেগুনের মতো হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছি চশমা। 


“অর্চি, কিক কর…”


কানে বিশ্বর গলাটা কোনোমতে শুনতে পেলাম। যা হবে হোক। দশরথ বা হিমাংশু (চোরাবালি দ্রষ্টব্য)র ন্যায় শব্দভেদী গোল করবো এবার। 


বলটা পায়ের কাছে আন্দাজে বুঝে গোলের দিকটা মেপে শরীরের সব জোর দিয়ে একটা লাথি মারলাম। ফাইনাল হুইসল বাজলো।


মাঠে প্রবল চিৎকার আর হতাশা। আনন্দে, প্রশান্তিতে চোখ বুজে এলো আমার। পেরেছি, আমি পেরেছি। আমার প্রথম ফুটবল ম্যাচেই আমি উইনিং গোল স্কোর করেছি, তাও মাঝমাঠ থেকে মাপা বেল্টারে! জার্সিতে একটা চুমু খেলাম, মাঠে একটা চুমু খেলাম - দিয়ে থু থু করে খানিকটা কাদা ফেললাম। দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে স্লাইড করে সেলিব্রেট করছি, হঠাৎ খেয়াল হলো, চারপাশটা কেমন নিশ্চুপ। সন্দেহ হল। 


“এই নে, তোর চশমা। একবার দেখ!”


অর্ক এনে দিলো। 


“থ্যাঙ্কস ভাই!”


“আর থ্যাঙ্কস! দেখ একবার!”


সন্দেহ হলো আবারও। চশমাটা কোনোমতে পরে গোলের দিকে তাকালাম। একী, ওদের গোলে লোক কই! তবে কী…


আমাদের গোলের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাই। দেখি, সাদাকালো বলটা আমাদের জালের মধ্যে বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে। আমার দিকে সবাই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে।


একসপ্তাহ স্কুলে যাইনি আর। 


ওই আমার প্রথম, আর শেষ ফুটবল খেলা। ফুটবলে কোনোদিন আর পা ছোঁয়ানোর প্রবৃত্তি হয়নি।


পুনঃ - নাম ইত্যাদি সঙ্গত কারণেই পরিবর্তিত।

Comments

Popular Posts