বিদায়, পত্রাবলী...
ভার্চুয়াল চিঠি নিয়ে কদিন বেশ মেতে থাকা গেল যা-হোক। কিছু ভালো অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, খারাপ লাগার রেশটুকুও রইলো।
আমাকে যাঁরা একটু হলেও চেনেন, তাঁরা জানেন চিঠি জিনিসটা আমার কতটা প্রাণের। আমি মনে করি, চিঠির থেকে সৎ, আপন এবং হৃদয়াবেত্তাসম্পন্ন লেখা আর কিচ্ছুটি হতে পারে না। যে আবেগানুভূতিকে 'ম্যাচিওর' মানুষজন ব্রাত্য করে রাখেন - মানে, ফেসবুক পোস্টে প্রবল আবেগ দেখান এবং ব্যক্তিগত স্তরে সেই আবেগকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি মারেন - সেই আবেগানুভূতিকে সবথেকে স্পষ্ট, সহজ, সরল, রাখঢাকহীনভাবে কেউ যদি তুলে ধরতে পারে, তবে তা হল চিঠি। তার মধ্যে ভান নেই, কোনো লুকোচুরি নেই, নিজেকে মেলে ধরতে কোনো বাধা নেই। চিঠি একটা মানুষের মনকে যেভাবে তুলে ধরে, তা অত্যন্তই বেনজির - যেজন্য, আমরা কোনো মানুষকে জানতে গেলে, বিশেষ করে বিখ্যাত মানুষদের - চিঠি বা ডায়রির শরণাপন্ন হই।
এইজন্যই, বরাবর আমি চিঠি লিখতে ভালোবাসি। প্রথম চিঠি লিখেছিলাম একটি মেয়েকে, যাকে আমার পছন্দ ছিল। তখন পড়ি লোয়ার কেজিতে। মেয়েটি আমাদের ফ্ল্যাটেই থাকতো আর আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। সম্ভবত এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত সে। হারিয়ে-যাওয়া মামাবাড়ির বারান্দায় এক শীতের দুপুরে বসে বসে তাকে ৫ পাতার একটা চিঠি লিখেছিলাম, যাতে 'তোমাকে না দেখলে আমার খুব মন খারাপ করে, তুমি স্কুলে রোজ আসো না কেন, তোমার ওই লাল রিবন দিয়ে বাঁধা বেণী আমার খুব ভালো লাগে, তুমি চাঁদের মতো স্নিগ্ধ' ইত্যাদি লিখেছিলাম। কচি বয়েস থেকেই সুমন-মান্না শুনে গাছপাকা আমি চিঠিতে গানের লাইনটাইনও দিয়েছিলাম বিস্তর। সবই ভালো, কিন্তু সেই চিঠি তাকে আর সাহস করে দিয়ে উঠতে পারিনি। ব্যাপারটা মনে পড়লে এখন বেশ হাসিই পায়, তার মধ্যে আবার সামনের মাসে তার বিয়ে।
ভালোবাসলে চিঠি লেখা ব্যাপারটা সেই তবে থেকে আমার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে জুড়ে গিয়েছে। কিন্তু, অদ্ভুতভাবেই - সেই অনুভূতিগুলো কোনোদিন ফিরে আসেনি আমার কাছে। কোনোদিন বললে হয়তো মিথ্যে হবে যদিও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই অনুভূতিগুলোকে দেখেছি খোলা বাজারে বিকিয়ে যেতে। ভালোবেসে চিঠি লিখে উত্তর না পাওয়ায় যত না কষ্ট হত, তার থেকে বেশি খারাপ লাগতো সেই চিঠিগুলো নিয়ে উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পরিচিতরা ঠাট্টা-তামাশা করছে। আবেগ, যা কিনা একান্তই আপন, সেই ধবধবে শ্বেতশুভ্র আবেগকে কুৎসিত তামাশার কালিঝুলি মেখে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখতাম।
তাও, হাল ছাড়িনি। লিখে ফেলতাম চিঠি। ভালোবাসলে চিঠির থেকে দামি আর কিছু হতে পারে, এমনটা মনে হয়নি কোনোদিন।
আমার প্রাক্তন প্রেমিকা আমাকে প্রথম প্রথম দুয়েকটা চিঠি লিখেছিল। তারপরে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ে। একটা চিঠির থেকে আরেকটা চিঠির দূরত্ব বাড়তে থাকে, বাড়তে বাড়তে চিঠিগুলো হারিয়ে যায়। আমি তবুও লিখতাম। থামাইনি। কখনো পড়ত সে, কখনো না। বেশিরভাগ সময়েই একটা 'তুই কী সুন্দর লিখিস!' মার্কা স্টক উত্তর তার ঠোঁটের গোড়ায় লেগেই থাকত। অথচ, আমি আমার লেখার প্রশংসা শুনতে চাইতাম না। চাইতাম, সে যেন পড়ে। আমাকে স্তোক দিতে নয়, ভালোবেসে। সেটার উত্তর লেখে। চিঠির উত্তর দেওয়া কি খুবই কঠিন? হয়তো নয়। কিন্তু, মনকেও সায় দিতে হয়। চিঠির উত্তর অঙ্ক নয়, যে জোর করলেই মিলবে।
তাকে শেষ চিঠিটা লিখেছিলাম গত বছর ডুয়ার্সে বেড়াতে গিয়ে। চিলাপাতার জঙ্গলে বসে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে, এক মনকেমন করা সন্ধেতে, অখিলবন্ধু শুনতে শুনতে তাকে চিঠি লিখেছিলাম।
সে পড়েনি। 'অত বড়ো চিঠি পড়তে ভাল্লাগছে না। পরে দেখা যাবে।'
পড়েনি আর সে। জানতাম, পড়বে না। আমিও অনুরোধ-উপরোধের পথ বহুদিন হলো হাঁটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, শান্তির জন্য।
শান্তি। কত ছোটো শব্দ, কিন্তু কী প্রবল প্রভাব তার। সারাটা জীবন, আমরা শুধু পাগলের মতো শান্তি খুঁজে চলি। পাই না কেউই। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা শুধু শান্তি কিনতে চাই দুমুঠো, কিন্তু পাই না। সেই দাম চুকিয়ে দেওয়ার মতো ঋদ্ধ হতে পারিনা আমরা।
সে ছেড়ে যাওয়ার পরে নিজের মতো করেই একের পর এক না-পাঠানো চিঠি লিখে যেতাম। আমি নিজের চিঠিগুলোর অধিকাংশই কাউকে উদ্দেশ্য না করে লিখে যেতাম আগেও - 'ঠিকানাবিহীন চিঠি' নামে। সেরকমই লিখে যাচ্ছিলাম।
তখনই, ভালো লাগল একজনকে। যা হয়। একটা শূন্যতা ভরাট করতে গিয়ে ভালো লেগে যাওয়া। তাকেও পরের পর চিঠি লিখে গেছি। নিরর্থক। সে তার মতোই, দিব্যি চলে গিয়েছে। 'সময়েই যে যাওয়ার যায়, মেনে নিতে শিখেছি বিদায়...' সুমন লিখেছিলেন।
তারপরেও, তারপরেও ভালোবেসেছি। চিঠি লিখেছি। অপমানিতও হয়েছি। শুধু ভালোবেসে যে এতটা অপমানিত হওয়া যায়, তা জানা ছিল না। বন্ধুদেরকেও চিঠি লিখেছি। তারাও, দুয়েকজন বাদে, কেজো-কেঠো উত্তর দিয়েছে। কিন্তু, যাদের থেকে পাওয়ার ছিল, তারা কেউ ফিরিয়ে দেয়নি। সত্যিই, চিঠি লেখা বড্ড কঠিন। অনেক সময় লাগে। অনেক কষ্টস্বীকার। আবেগ-টাবেগের মতো ছেঁদো জিনিস মানায় না। আমার বয়সোপযোগীও নয়, পেশাপযোগী তো আরোই নয়।
একটা সময়ে হাল ছাড়তেই হয়। হার মেনে নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হয়। নিয়েছি। চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার ভালোবাসার চিঠিলেখাকে যত্ন করে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দিয়েছি। নেড়েঘেঁটে তার নাভি নিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছি গঙ্গায়।
ভালো থাক চিঠিরা। যে চিঠিগুলো কোনোদিন ঠিকানা পেল না, ভালোবাসা পেল না, উত্তর পেল না, প্রত্যুত্তর পেল না - তারা সবাই ভালো থাকুক। আমি না লিখলে যদি তারা ভালো থাকে, তবে তাই সই।
জীবনে তো কত কিছুই ছাড়তে হয়। না হয়, নিজের সবথেকে আপন চিঠি লেখাটাই ছাড়লাম! অপমানের থেকে, অবহেলার থেকে, উপেক্ষার থেকে, তাচ্ছিল্যের থেকে তা অনেক ভালো।
তাই এই কদিন একটু এই চিঠি-নামের খেলনা চিরকুটে, বেনামী খেলায় মেতে ছিলাম। তার পালা মিটল। ধন্যবাদ, যাঁরা আমাকে লিখেছেন। যাঁরা লেখেননি, তাদেরও ধন্যবাদ। যাদের চিঠির আর উত্তর দেওয়া হবে না, তাদের কাছে দুঃখিত। তবে, কথা হবে, গল্প হবে।
বিদায়, পত্রাবলী। :)
Comments
Post a Comment