বর্ষামঙ্গল
শেষমেশ বর্ষা এলেন। ভৈরব হরষে না হলেও, তিনি এলেন - আগমন তো নয়, যেন আবির্ভাব। ভূগোল (যাতে আমি প্রচণ্ড ভালো, এটা আমার ধারণা - তবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বা আমার স্কুলের ছিলো না) পড়তে গিয়ে একটা জিনিস পড়েছিলাম, যাকে NLM বা Northern Limit of Monsoon বলে - ম্যাপের উপর একটা আইসোলাইন টানা হয়, যেটা দিয়ে কোথায় কোথায় কবে বৃষ্টিপাত আসে এই পোড়া দেশে, সেটা দেখা যায়, এবং যত দিন বাড়ে, তা উত্তরে সরতে থাকে। সেই NLM অনুযায়ী, ভারতে (আন্দামান নিকোবর এবং কেরালা) বর্ষা আসে মোটামুটি ১লা জুন, আর পশ্চিমবঙ্গে আসতে আসতে প্রায় ১০ই জুন। কিন্তু সমস্যা হলো, এতো গালভরা কথা আমি জানি, ভূগোল জানে, NLM-ও হয়তো জানে - বর্ষা কি জানে? আমার ধারণা, হয় সে জানে না, বা বেশি জেনে যাওয়ার ফল হিসেবেই, মানে না। আবহাওয়া দপ্তর আর কালিদাসকে ইল্লি দেখিয়ে খিল্লি করে সে মক্কেলের ঠিক করে আসতে আসতে লেগে যায় প্রায় জুনের শেষাশেষি - আর এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অবশেষে, তিনি এলেন, দেখলেন - এবং ভিনি-ভিডির পরে ‘ভিসি’ বলার বদলে সারমেয়ের হিসির ন্যায় দু-চারফোঁটা ঝরিয়ে বিদায় নিলেন। তাতে ছাতা বা ছাতার মাথা, কোনোটাই লাগছে না, উল্টে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে - কিন্তু কী আর করার। প্রকৃতির ডাক, সেই জানে কখন সাড়া দেবে…
এই বর্ষা নিয়ে যুগে যুগে কালে কালে বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-গায়ক-নাট্যকার এবং বিশেষ করে কবিরা পাতার পর পাতা ধারাবিবরণী নামিয়েছেন। মেঘদূত তো বটেই, কালিদাস ঋতুসংহার-এ বর্ষাবর্ণনা অংশে মোটামুটি আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন - যেটা পড়তে গেলেই আমার বরাবর মনে হয়, ‘মোহরা'-র ‘টিপ টিপ বরষা পানি'র এতো সুন্দর সংস্কৃত ভাবানুবাদ বোধহয় কালিদাস ছাড়া আর কেউ করতে পারতেন না। যাইহোক, কালিদাস তো ক্লিশে, সেই দিশেতে হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছেন অনেকেই। জয়দেবের ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরং বনভূবস্তমালদ্রুমৈঃ’ ইত্যাদি বলে গাছে উঠিয়ে মই কেড়ে নেওয়া তো আছেই। বিদ্যাপতি বর্ষা দেখলেই মোটামুটি জন্তুদের কোরাস-কনসার্ট বসিয়ে দিতেন - এক্কেরে হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে কেস। চারপাশে প্রোষিতভর্তৃকারা বসে সমস্বরে বিলাপ করছে, তাদের প্রেমিকভাইরা দূরপ্রবাসে গিয়ে তাদের ‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ করে দিয়েছে, ময়ূর-টয়ূরেরা কেয়াঁ কেঁয়া কেঁয়া হুঁয়া তেঁরা ওঁয়াদা বলে গান ধরেছে… পুরো যাকে আজকালকার ছেলেমেয়েরা ‘ভাইব’ বলে মামা! তারমধ্যে ছোটোবেলায় ‘মত্ত দাদুরি'টাকে পড়ে ভাবতাম, বৃষ্টির ওয়েদার দেখে কোনো দাদু নির্ঘাত টান্টু হয়ে বসে আছেন। বড়ো হয়ে যখন দাদুরির অর্থ জানবার সৌভাগ্য হলো, তখন প্রতিক্রিয়ায় ‘ধুর ব্যাং!’ বাদে আর কিছুই বলতে পারিনি। আর রবীন্দ্রনাথ তো, ছেড়েই দিলাম। ভদ্দরলোক পদ্মাবোটে বসে দাড়ি চুমরে চুমরে বর্ষা নিয়ে যা সব লিখে গেছেন, সেইসব দেখলে স্বয়ং বর্ষা কমপ্লেক্স খেয়ে যাবে, যে ‘ভাই আমার মধ্যে তুই এতো কী দেখলি?’ সত্যিই, প্রেম আর কবি, উভয়েই অন্ধ। রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিতে মেতেছেন, নেচেছেন, মনকে ময়ূরের মতো নাচিয়েছেন, বৃষ্টিকে বাঈজী বানিয়ে নূপুরনিক্বণ সহযোগে নাচিয়েছেন… সাধে তিনি গুরুদেব! যাইহোক, সাহিত্যের ইতিহাসের উইয়ে খাওয়া পাতা পেরিয়ে, দেশকালপাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে বরাবর বর্ষাকাল নিয়ে লোকজন চূড়ান্ত মাতামাতি করেছেন, এখনো করেন। নারাণ গঙ্গো যেটা নিয়ে লিখেছিলেন, কবিরা বোশেখ মাসে দোর এঁটে ‘বাদলরাণীর নূপুর বাজে তাল-পিয়ালের বনে’ লেখে, যাতে আষাঢ়ে গিয়ে তা ছাপা হতে পারে।
প্রশ্নটা হচ্ছে, এই মাতামাতি কেন? কী এমন আছে এই ঋতুতে, যার জন্য এমন কেজি কেজি আবেগ ঢেলে চচ্চড়ি বানানো হয়?
বর্ষা নিয়ে বিশেষ করে আমার অন্তত আবেগগুলো বড্ড কম। এই নিয়ে লোকজন আঁতকে ওঠার আগে জানাই, বছরতিনেক কলেজ স্ট্রিট-আমহার্স্ট স্ট্রিটে পুরো বর্ষাকাল কাটানোর সৌভাগ্য (বা দুর্ভাগ্য) হয়েছে আমার। আমাদের কলেজ শুরু হয়েছিলো বর্ষাকালে। প্রথম দিন থেকেই বর্ষাভাই তিতিবিরক্ত করে তুলেছিলেন। মনে আছে, ১১ই অগাস্ট প্রথম ক্লাস ছিলো। কলেজের গেট থেকে ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং-এর দূরত্ব ছিলো হেঁটে মিনিট দুয়েক। একটা সিগারেট ধরিয়ে আশ্লেষে টানতে টানতে কদম কদম বাড়িয়ে গেলে আগুন ফিল্টার ছোঁয়ার আগেই পা নেতাজী সুভাষ বিল্ডিং (যেখানে ক্লাস হতো)-এর সিঁড়ি ছুঁয়ে ফেলতো। প্রথম দিনেই হেঁটে ক্লাসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে একপশলা বৃষ্টি কিশোরী মেয়ের হৃদয়ের মতো আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছিলো। সেই অলপ-বয়সী-বালার প্রেমোচ্ছ্বাসে ভিজে ক্লাসে ঢুকে সুন্দর কাব্যরমণ করছিলাম নতুন বন্ধুদের সঙ্গে, ততক্ষণে গা-হাতপা বেশ শুকিয়েও গেছিলো। খানিকক্ষণ পরে বাইরে শুকনো আকাশ এবং দুয়েকজনের শুকনো ঠোঁট দেখে ভোটাভুটি করে ঠিক হয়, ক্যান্টিনে গিয়ে চা-সিগারেট ঠেঙিয়ে আসা হবে। বেরোতে না বেরোতেই, কীমাশ্চর্যম, আবার এক পশলা বৃষ্টি, আবার আবার সেই কামান গর্জন.. তখন থেকেই বুঝেছিলাম, কিশোরীর প্রেমে পড়াটা তারানাথ বাদে আর কারোরই কাম্য নয় - এরকম মুড সুইং কার হয়! তখন থেকেই আমার বৃষ্টি (এবং কিশোরী)র প্রতি বিতৃষ্ণা। তার দুয়েকদিন বাদে বিভাগে টিচার্স ডে ছিলো, যেটা আমরাই পালন করতুম (মানে ফ্রেশাররা)। সেই টিচার্স ডে-উপলক্ষে ঠিক করা হলো, প্রফেসরদের মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়ানো হবে। আর অবশ্যই, সর্বঘটের কাঁঠালিকলা ছিলাম আমি - বেরিয়ে পড়লাম বন্ধু-সহপাঠী নীলাব্জর সঙ্গে মিষ্টি কিনতে পুঁটিরামের উদ্দেশ্যে। গেলাম, দেখলাম, কিনলাম, পুঁটিরামের কচুরি-মিষ্টি দই খেয়ে যখন বেরোচ্ছি, তখনও আকাশ ফরসা। ঠিক বাইরে বেরোলাম, আর ট্রমা ডাম্প করার মতো করে আকাশ জল পাম্প করা শুরু করে দিলো। ভাইরে ভাই, সে কী বৃষ্টি! কলেজ স্ট্রিটে আছি, নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো এক ঘূর্ণাবর্তে - বোঝাই চাপ। বৃষ্টির তোড়ে আর ঝড়ে চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি নীলাব্জ ভেবে বেমক্কা একটি অচেনা মেয়ের হাত টেনে ধরে হিড় হিড় করে ‘চল ভাই, কেচ্ছা হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি না ঢুকলে’ বলে হাঁটা শুরু করলাম হনহনিয়ে। হঠাৎ শুনি, পাশ থেকে কম্বুকণ্ঠে এক রমণী বলছেন ‘বাবু, এতো রাগ করিস না। সরি বলছি তো!’ বুঝলাম, কেস জন্ডিস করেছি। নীলাব্জ-র জায়গায় নীলাব্জকুমারীর হাত ধরে টেনেছি, এবং ব্যাপারটা তার বোধগম্য হলে দৃষ্টি এবং আরো অনেক কিছু বঙ্কিম হয়ে যাবে। সেই ঘন প্রাবৃটকালে ওই অসহায়া, বাবুহারা রমণীর চম্পকশুভ্রা করকমল পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ করিলাম না। কলেজে ফিরে শুনি, নীলাব্জ এক ঠেলাওয়ালাকে আমি ভেবে তার সঙ্গে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে চলে এসেছে কলেজে। সেবার দুজনেই খুব মার খেতে খেতে বেঁচেছিলাম। এরকম কতোবার বৃষ্টিতে ছাতা হারিয়ে, ম্যানহোল বাঁচিয়ে, রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির সস্তার হোলিখেলায় ধ্বস্ত হয়ে বর্ষা কাটিয়েছি, আর মনে মনে কবি-সাহিত্যিকদের বাপ-ভাই তুলে গালাগাল করেছি। প্রমথ চৌধুরীর ‘বর্ষার কথা’ পড়ে মনের জ্বালা একটু জুড়িয়েছিলো। আমার সহপাঠীরা জানে, গোটা বর্ষাকাল আমার ব্যাগে খাতাপত্র না থাক, এক সেট জামা-প্যান্ট থাকবেই - কেউ আটকাতে পারবে না। সারা বর্ষাকাল গুলিখোরদের মতো ভিটামিন সি ট্যাবলেট চুষে যাচ্ছি, আর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে রয়েছি। এই ঋতুকে ভালো লাগে কোনোভাবে? যে শালা হতচ্ছাড়ারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা কফি-কাপ হাতে বাইরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে ‘ঝম্পি-ঘন-গরজন্তিসন্ততি ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া’ মার্কা ধ্যাষ্টামো মারে, তাদের ছেড়ে দিতে হয় বর্ষাকালের উত্তর কলকাতায়। অ্যামহার্স্ট স্ট্রিটে কিছুকাল আগেও নৌকা চলতো বর্ষাকালে, ইয়ার্কি মনে হলে পুরোনো লোকেদের সঙ্গে ক্রসচেক করে নেবেন। আর কলেজ স্ট্রিটে তো, বাবা। রাস্তাঘাটে থুতু ফেলতে অবধি ভয় পেতাম, যদি জল জমে! কিছু হতে না হতেই কলেজের সামনে এক কোমর জল। নিজেকে হ্যান্ডমেড মারমেইড মনে হতো, মাইরি। সারাক্ষণ সবাই পোলো খেলতে খেলতে অথৈ জলে থইথই করে ভেসে বেড়াচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে ক্লাসে যাচ্ছি, ক্যান্টিনে যাচ্ছি। যারা সিগারেট খেতুম, তাদের যে কী দুর্দশা! অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করেছিলুম একটা - একটা ট্রেনে বিক্রি হওয়া বাদামের প্লাস্টিকের লম্বাটে ঠোঙার দুদিক ফুটো করে মাঝখান দিয়ে সিগারেট ঢুকিয়ে টানতাম। গায়ে রেনকোট পরে, ভেসে ভেসে মুখে ওই প্লাস্টিক গুঁজে শ্যালদা থেকে যখন আসতাম, দেখে হয় বিধুশেখর, নয় অ্যাং, নয় সাপ-ব্যাং-বিচ্ছু গোত্রের ভয়াবহ কিছু একটা লাগতো।
তবে বর্ষার কী সবই খারাপ ছিলো? নাঃ। অন্তত একটা বর্ষাকালের জন্য আমি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতাম। তখন যে মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতাম, সেই মেয়েটি বজবজ থেকে শ্যালদা আসতো, আমি খড়দা থেকে - দুজনে নর্থ-সাউথ এক হয়ে শ্যালদা থেকে হেঁটে কলেজ যেতাম - আর প্রাণপণে চাইতাম, যেন বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি আমাকে নিরাশ করেনি। বৃষ্টি নামলেই আমি মুখ কুঁচকে ‘যাহ, ছাতা আনিনি আজ’ মার্কা প্রচণ্ড সত্যি বলতাম, আর ব্যাগের ভিতরে থাকা মহেন্দ্র দত্ত আমাকে প্রচণ্ড গাল পাড়ছে, এমনটা বুঝতাম। সেই মেয়েটি তখন ছাতা বের করতো, দুজনে এক ছাতার তলায় হাঁটতাম কলেজ অব্ধি। ওইটুকু, ঠিক ওইটুকুর জন্যই, বৃষ্টিকে আমি ক্ষমা করতে রাজি আছি। মুহূর্তের ঘনিষ্ঠতা, গায়ে গা লেগে যাওয়া, গালে গাল ছুঁয়ে যাওয়ার যে ওম, তার আঁচকে নিভিয়ে না দিয়ে তাজা করে তোলাই যে বৃষ্টির কাজ! দুর্ভাগ্যবশত, বা তার সৌভাগ্যবশত, সে হয়তো এখন অন্য কারোর সঙ্গে ছাতা নিয়ে হাঁটে, আমিও আজকাল আর নিজের ছাতা ছাড়া পথ হাঁটি না। প্রত্যেকের জীবনেই এরকম একেকটা বৃষ্টি থাকে, যা তাদের প্রচণ্ডভাবে ভিজিয়ে দিয়ে যায় - যে ভেজা থেকে সেরে ওঠা আর হয় না কোনোদিনই।
বৃষ্টি নিয়ে কেন এতো লেখালিখি, তার উত্তরটা বোধহয় এই শেষছত্রেই লুকিয়ে আছে। বৃষ্টি একই সঙ্গে আশা জাগায়, আশা ভাঙেও। প্রবল দগ্ধ দুপুরের শেষেও প্রকৃতিচক্রের অদ্ভুত খেয়ালে বৃষ্টি যে নামবেই, যতই দেরি করুক না কেন - এই আশায় বুক বাঁধে কতো মানুষ। বৃষ্টি সেই বুক বাঁধারই প্রতীক, যে ‘দের আয়ে, পার দুরুস্ত আয়ে।’ আবার বৃষ্টি আশা ভাঙেও। এই বৃষ্টির দিনের মনকেমনিয়া সুরের ছলনায় দূরে সরে যায় মানুষ, দূরে চলে যায়। বৃষ্টি তাই বিরহের ঋতু, মিলনেরও - সমগ্র নিসর্গপ্রকৃতি মিলিত হয়, আর প্রিয়াহৃদয় দূরপ্রবাসে থাকা কান্তের জন্য মন উচাটন করে গুমরে গুমরে মরে;
‘কান্ত এখন দূর প্রবাসে,
মন উচাটন। বর্ষা আসে।’’
বিরহে আমরা সবাই তাই আসলে উতলা রাধা৷ আমাদের সবার বুকেই প্রবল বর্ষা ঝরে পড়ে, যার একটা বিবর্ধিত প্রতিফলন বিশ্বপ্রকৃতির বুকে দেখি। তাইই হয়তো বর্ষা ঋতুশ্রেষ্ঠ!
Comments
Post a Comment