মহাবিদ্যাদর্পণ
*মহাবিদ্যাদর্পণ*
শাস্ত্রে বলে, চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা। আমি চিরকালের বিদ্যানুরাগী, ফলে এই মহাবিদ্যাতেও আমার স্বাভাবিকভাবেই চূড়ান্ত আগ্রহ। এমনিতেও, চুরি ব্যাপারটা আমার বরাবরই দারুণ এক্সাইটিং লাগে - যদিও তা কিছু ক্ষেত্রে এক্স-সাইটিং এর মতোই বেদনাদায়ক। কিন্তু, বেদনা না থাকলে কোনোকিছুতেই প্লেজার আসে না, বরং বেজার মুখে থাকতে হয়। বেদনাই সুখের মূল - এই মূল কথাটাকে সার মেনে বরাবর এগিয়েছি।
জীবনে চুরি অনেক করেছি - বাবার পকেট থেকে সিগারেট বা ক্যাবিনেট থেকে বোতল, অসংখ্য মেয়েদের মন, অন্যের জীবনের শান্তি, রান্নাঘর থেকে খাবার ইত্যাদি৷ কিন্তু সবথেকে বেশি অদ্ভুত এবং খতরনাক (কারণ প্রায় নাক খত দিতে হয়েছিলো) অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বই চুরি করতে গিয়ে। নিজের জীবনের এই অসংখ্য খুচরো পাপ, বা কিছুক্ষেত্রে বড়োসড়ো পাপও এক-এক করে স্বীকার করে রাখা উচিত।
বই চুরি না করলে প্রকৃত আঁতেল ও শিক্ষিত হওয়া যায় না, এমনটা বহু বিদগ্ধজন ফেসবুকে বরাবর দাবি করে এসেছেন। বহু লোক যে কলকাতা বইমেলা পিছু হাজার পঞ্চাশেক টাকার বই ঝেঁপে দেন, এমনটা মেপেঝুপে দিব্যি বলে দিতেন, আর আমি স্বপ্নালু চোখ করে সেইসব পোস্ট পড়তাম, আর নিজের অক্ষমতায় দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আমিও কি পারবোনা এদের মা'কে মাসি বলতে? এইসব ভুবনভোলানো ভাবনা ভাবতাম।
২০১৬ সালে কলেজে উঠলাম, আর কলকাতা বইমেলা ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুর, থুড়ি মিলনমেলার সঙ্গে বিচ্ছেদের খেলা খেলে নতুন খেলা খেলতে এলো সেন্ট্রাল পার্কে। পাড়ার ছোট্টো পার্ক না হলেও, তাতে ঘাস ছিলো না আর ধুলো প্রচুর ছিলো - তবুও, অসম্ভব অ্যাকসেসিবল একটা জায়গা হওয়াতে মনটা বেশ নেচে উঠলো। আসছে, বইচুরির দিন আসছে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ি, আঁতলামির হদ্দমুদ্দ না করলে শান্তি নেই - আর তাতে কাঁটা হয়ে আছে এক বইপড়া। যদিও আমার এক বহুপূর্বের বিভাগীয় সিনিয়র আঁতলামির পরাকাষ্ঠা রচেছিলো ২০০৭ সালে বার্গম্যানের মৃত্যুতে মস্তকমুণ্ডন করে। যদিও তাতে বার্গম্যান পদপল্লব উদার করে উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিলেন কিনা, সেই তথ্য ইতিহাস জানায় না। যাইহোক, এতো উঁচুতে সেট করা বারের বাড়াবাড়িতে না গিয়ে, বা অতি বাড়ে পড়ে ঝরে না গিয়ে বাকিগুলোয় ছিলাম। এইসব খুচরো পাপের মধ্যে ফার্স্ট সেমেস্টার থেকেই বন্ধুবান্ধবদের পাকড়ে ডায়ালেক্টিক্স বোঝানো, দুমদাম নেমড্রপিং - দিনের মধ্যে অন্তত দুবার গ্রামশির নাম না নিলে মুখ আমসি হয়ে যেতো, আলথুজার না বললে মুখ ব্যাজার আর বাকুনিন না বললে উদাসীন হয়ে যেতাম, সিনেমা সম্পর্কে কিচ্ছু না বুঝে দমাস করে কিম-কি-দ্যুক, কিয়েসলোস্কি ইত্যাদি হ্যাজানো… সবকিছুই করে যাচ্ছি। কিন্তু বইমেলা থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত বই চুরোতে না পারছি, ততোক্ষণ এই আঁতেলসমাজ আমাকে কড়ে আঙুল কেটে ইয়াকুজা বা বুড়ো আঙুল কেটে একলব্য, কোনোটাই করবে না - বরং বুড়ো আঙুল দিয়ে (নাকি দেখিয়ে?) ভাগাবে। অতএব, আমিও ভাবলাম, এবার অ্যাকশনে নামতে হবে। দেখিয়ে দেবো বাঙালি কী পারে। পথে এবার নামো সাথি ইত্যাদি…
এবার, অ্যাকশনের আগে কচুগাছ লাগবে। কচুগাছ কোথায় পাই? অনেকভেবেচিন্তে মনে পড়লো, আমাদের খড়দহ বইমেলাই আছে, হাতের পাঁচ। কচু তো বটেই, কচুগাছ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। অতএব, খড়দহ বইমেলা দিয়েই হাতেখড়ি, বা হাতেচুরি শুরু।
জনা চারেক বন্ধু এবং এক বন্ধুর দাদাকে নিয়ে বইমেলার বন্ধুর পথে এগোলাম। খড়দহ বইমেলায় টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন সিস্টেম - ঢোকার সময়ে টিকিট দেখে, আর বেরোবার সময়ে বিল দেখে বেরোতে দেয়। মানে বিল না দেখিয়ে তোমার ‘আসি’ বলার জো নেই - বিলাসীতার চরম। ফলে, এই খেলায় যদি পাশ করি, তাহলে কলকাতার সবুজ, থুড়ি ধুলোঢাকা ধূসর মাঠ আমার জন্য অপেক্ষা করছে, গ্যালারিতে সারি সারি লোকজন..
মেলার মাঠে ঢুকে বন্ধুবান্ধবদের আমার প্ল্যান বললাম। বন্ধুরা এই বন্ধুর প্রকৃতির প্ল্যানের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ রাজি। আমার আনন্দ দেখে কে! এই তো আমার কমরেড, এই তো আমার আঁতেলভাই.. চোখে জল চলে এলো। হুডির খুঁটে মুছে নিলাম চোখ। তলেতলে স্টলে ঢোকা শুরু হলো।
সমস্যা হলো, বই চুরি তো হবে, এবার কী বই ঝাঁপি? আমার বন্ধুরা হাতের সামনে যা পাচ্ছে, আমাকে পাস করে যাচ্ছে। কেউ বেণুদির রান্নাবান্না, কেউ সচিত্র জ্যোতিষচর্চা, তো কেউ সহজে পশুপাখি চিনুন। নিজের এবং মেলার উপর মেলা হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। আনন্দ বা দে’জ-এ যাইনি - ওই একঘেয়ে বই চুরি করার থেকে বইপড়া ছেড়ে দেওয়া ভালো। আমাদের এখানে আনন্দ আসে শুধুই টিনটিন, স্মরণজিৎ, সুচিত্রা আর ফেলুদা বেচতে - তাতে একটুও আনন্দ হয় না। দে'জেও খুবই লিমিটেড - মূলত শংকর, কিছু বুদ্ধদেব গুহ। আমার আবার তখন ইংরেজি বইয়ের নেশা চাগিয়ে উঠেছে। কী করার?
অবশেষে এক স্টলে ঢুকে তুলনামূলক পদের বই পেলাম কিছু। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, পছন্দের উপন্যাসটা নেবো - আগেই পিডিএফে পড়া, কিন্তু বইটা ঝাড়বো। কী বই? না, জেডি স্যালিঞ্জারের বিখ্যাত বিল্ডুংসরোমান, ক্যাচার ইন দ্য রাই। জয় বাবা হোল্ডেন জপতে জপতে বইটিকে হাত করলাম, হাতালাম। হাতিয়ে সোজা হুডির তলায় - শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। বুক তখন ঢিপঢিপোচ্ছে। চারপাশে বহু লোকের ভিড় থাকায়, ক্যাশিয়ার ক্যাশের ইয়ার হয়ে ক্যাশ গোনায় ব্যস্ত থাকায় খুব একটা অসুবিধে হয়নি যদিও।
এবার হুডিতলায় তো তিনি গেলেন, কিন্তু তাঁকেও তো বেরোতে হবে। আর গেটের সামনে বিল চাইবে - বিলোতে না পারলেই কিলোবে, তাও বিলো দ্য বেল্ট। ভেবেচিন্তে ঠিক করা হলো, আরেকটা বই কেনা হবে। দাদার বাবার জন্য একটা রামকৃষ্ণ কথামৃত গোছের কিছু একটা নেওয়া হলো। সেই বিলের তলায় ক্যাচার ইন দ্য রাই-এর নাম লেখা হবে, সেটা ঠিক হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা গেলো অন্য জায়গায়। কারোর কাছে একটাও পেন নেই। জীবনে এতো পেন, অথচ কারোর কাছে একটাও পেন নেই - ভাবতেই পারছি না। আমরা তখন পাগলের মতো পেন খুঁজছি। যাকেই দেখছি, তাকেই ‘দাদা একটা পেন…’ বলতে না বলতেই সে তিড়িং করে এক লাফ মেরে ‘না না বাপু, ক্ষমা করো। কী জ্বালা, এরা বইমেলাতেও পেন বেচতে চলে এসেছে!’ বলে লম্বা দিচ্ছে।
এসব শুনে প্রায় হতাশ আমরা যখন, ভাবছি বইমেলাতেই রাতে থেকে যাবো কিনা, তখন এক পরিচিতা দিদির সঙ্গে মোলাকাত। সেই দিদি ছিলেন কার্যনির্বাহী কমিটির মেম্বার আবার। মজার ব্যাপার, দিদির আবার আমাদের সেই সঙ্গী দাদাটির উপর প্রবল ব্যথা ছিলো। সেই পেইনকে কাজে লাগিয়ে পেনও জুটে গেলো - দিদিটিই অনেক ছোটাছুটি করে পেন জোগাড় করে দিলো। সেই দিয়ে বিলে লেখা হলো। কী ভয়ানক সেই বিল! ১ নং এন্ট্রি রামকৃষ্ণ কথামৃত, ২ নং এন্ট্রিতে ‘ক্যাচার’ লেখা শুধু, ব্যাপারটার মধ্যে অরিজিনালিটি আনতে। একই বিলে রামকৃষ্ণ আর হোল্ডেন কওলফিল্ড - এ যে কী ভয়াবহ আঁতাত, তা ক্যাচার.. যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাই জানেন। একটাই আশা, যাঁরা বিল দেখেন, তাঁরা অতোশতো পড়েননি। শিক্ষার অভাবও যে আশীর্বাদ, সেদিন টের পেয়েছিলাম। যাইহোক, সেই কাণ্ড করে অবশেষে বইমেলা থেকে মানে মানে বেরোনো।
মিশন কচুগাছ কমপ্লিট। এবার ডাকাত হয়ে কাত করে ফেলার পালা, দিয়ে আঁতেলসমাজের ভার্চুয়াল পিঠচাপড়ানির সুযোগ। জানুয়ারি এলো, সঙ্গে সঙ্গে শীত আর বইমেলাও হাত ধরাধরি করে চলে এলো।
বইমেলায় যাওয়াটা কলেজ থেকে বেশ সুবিধের ছিলো। ট্রেন ধরো, বিধাননগর নামো, অটো ধরো.. তখনো শ্যালদা থেকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো চালু হয়নি। কেউ মেট্রোয় একান্তই যেতে চাইলে এমজি রোড/সেন্ট্রাল থেকে মেট্রো ধরে শোভাবাজারে অবতরণ, এবং ব্রেকজার্নি বা রুটের বাস (বোধহয় ২১৮ যেতো করুণাময়ী অবধি, এখন খেয়াল আসছে না)। আমি ট্রেনপথেই যেতাম।
একদিন, পাঁজিপুঁথি না দেখেই, আঁতেলদের গুরু দেরিদা আর ফুকোর নাম জপতে জপতে ট্রেনপথে বেরিয়ে পড়লাম। প্রবল মারামারি করে উল্টোডাঙায় মানুষের ষাঁড়াষাঁড়ি বান সামলে নেমে, অটোযোগে বইমেলাবতরণ করলাম। সেদিন পুরো নাদির শাহ মুডে ছিলাম। নেমেই একজনের হাত থেকে টান মেরে ম্যাপ চুরি করলাম ভিড়ের মধ্যে। সেই ভদ্রলোক বুঝতে পারেননি কে নিয়েছে - একেবারে রেগে কাঁই। পাশের এক মহিলাকে তিনি রেগেমেগে জিজ্ঞেস করছেন দেখলাম,
"আমার ম্যাপ নিলেন যে বড়ো? আমি এখন চলবো কী দেখে? ইয়ার্কি হচ্ছে?"
মহিলাও ছাড়বার পাত্রী নন। সটান জবাব দিলেন, “ও মা! কে এলেন রে বড়ো! আপনি কি মৃত্যুঞ্জয় নাকি, যে আপনার থেকে ম্যাপ কেড়ে ধারাগোল খুঁজবো? এসব আজেবাজে বকলে সোজা পুলিশের কাছে দিয়ে দেবো বলছি!’’
লোকটি আরো চটে গেলেন। বললেন, “হ্যাঁ, তাই চলুন। দেখবো আজ ম্যাপচোরের কী হয়!”
এইসব হুমকি দিয়ে দুজনে হনহনিয়ে ফটকের সামনের পুলিশদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে চোরাই ম্যাপ নিয়ে আমি ফাঁপরে - শেষমেশ যঃ পলায়তি ইত্যাদি আউড়ে কেটে পড়লাম।
ইতিউতি হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, একজন অ্যাকম্পলিস হলে কাজটা অ্যাকমপ্লিশ করতে সুবিধেই হবে। ফোন করলুম আমার এক স্কুলতুতো বন্ধুকে - যে খোট্টা হওয়ায় আমরা তাকে ‘বা’ বলে ডাকতাম (তার কথায় মারাত্মক ভোজপুরী টান ছিলো বলে)। বা পড়তো সল্টলেক টেকনো ইন্ডিয়া কলেজে।
বা ফোন ধরে বললো, “হেঁ ভাই বোল।”
“ভাই, বইমেলায় এসেছি। আসবি? অনেকদিন দেখা হয় না।”
বইচুরির প্ল্যান বললে ও যে আসবে না, নিশ্চিত ছিলাম। হেব্বি ভিতু ছেলে। অতএব, সত্যগোপন করলাম।
“হেঁ ভাই, কোখোন আসতে হোবে, তুই সুধু একবার বোল।”
“এখনই চলে আয়। আমি বইমেলাতেই আছি।”
“আচ্ছা ভাই। আমি আধা ঘোন্টেমে আসছি।”
বা তো আধা ঘোণ্টায় আসবে, কিন্তু ততক্ষণ আমি কি ঘণ্টা বাঁধবো? ইতিউতি হেঁটে, হাত বাড়িয়ে ধরতে চাওয়া নতুন কবি-লিটলম্যাগসম্পাদক জুজুদের এড়িয়ে, দুয়েকটা স্টল ঘুরে দেখলাম। বুঝলাম, এসব জায়গায় বই ঝাঁপতে গেলে সত্যিই শিল্পী হতে হয়। খরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। তবে, খেপ খেলার মাঠ থেকে বার্নাবেউতে খেলতে গেলে তো ঢেউ সামলাতেই হবে কাকা! আঁতেল হতে এসেছি, এইটুকু না করলে চলে?
অনেক স্টল ঘুরে, ব্যাপারটাকে স্টল করতে করতে শেষমেশ গিয়ে ঢুকলাম রূপা-র স্টলে। ঢোকামাত্রই বুঝলাম, রূপার স্টল সুপার ব্যাপার, এক্কেরে চোরের স্বর্গরাজ্য। রীতিমতো বইয়ের দোকান হয়ে আছে, আমিও তাই দোকান-কাটার মতো, দোকান কাটবার মতো হয়ে ঢুকে পড়লাম - চারিদিকে বইয়ের তাক, দেখেই তাক লেগে যাচ্ছে। আর অন্ততপক্ষে খান ষাটেক লোক একসঙ্গে ভিতরে। চোখটোখ ঝলমল করে উঠলো। যাক, বা আসার আগেই বউনি করে নিতে পারবো।
একটা তাকের তলায় কাঁধের আড়াইমণি বোঝাটা নামালাম (আমার বন্ধুরা জানে, আমার ব্যাকপ্যাক আর আমার হৃদয় বরাবরই ভারাক্রান্ত থাকে)। ঠিক যেভাবে লোকে মাচা থেকে শশা পাড়ে, ওভাবে টপাটপ বই নামাতে থাকলাম ব্যগ্র হয়ে - ব্যাগে রো ধরে সেই বইগুলোকে ঢোকাতে থাকলাম। ক্রিস্টির 'মাউসট্র্যাপ', 'ব্ল্যাক কফি', 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান', 'মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস', 'ডেথ অন দ্য নাইল' - এতোগুলো ঝেড়ে ভাবলাম, পরেরপরে ক্রিস্টি নিলে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু বড্ড - খুবই অনাসৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও, আমার কৃষ্টি তো এতোটাও ক্রিস্টি নির্ভর নয়। অগত্যা, আগাথা ছাড়ো। অন্য গাথার দিকে এগোলাম। অন্য একটা তাকের তলায় এসে দাঁড়ালাম। অনেক বেছেবুছে রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর কিম ঝেঁপে দিয়ে যখন নিজেকে মনে মনে শুধোচ্ছি, ‘অতঃ কিম?’, তখনই বা-ভাই ফোন করলো।
“হেঁ ভাই, আমি এসে গেচি।”
ভাবলাম, নাহ। রূপার থেকেই সব নিলে তো হবে না - আমি তো আর হিমু নই - ফলে এই পানিপথ থেকে এখন বেরোই। আর, এবার বা-ও এসেছে, দুজনে মিলে ভালো করে ঝাড়বো।
বেরিয়ে এলাম। বা-কে আমার প্ল্যানটা বলাতে সে প্রথমে ঘাবড়ে গেলো, কিন্তু বইগুলো দেখাতে বেশ খুশি হলো।
“হাঁ ভাই, তুই এতোগুলো বোই চোরি করিয়েছিস? কিচু বোলেনি তোকে বা?”
এসব বলে মুগ্ধ, গর্বিত দৃষ্টিতে সে আমার চৌর্যকর্মের ফল দেখতে থাকে।
“টিক আচে ভাই, আমি তোর জোন্নো বোই চোরি কোরবো। কোনো চিন্তা নেই।”
কিন্তু চিন্তা যে আছে, সেটা কে জানতো!
যাগ্গে। দুজনে মিলে ভেবেচিন্তে সোজা গিয়ে ঢুকলাম একটা হলে। এদিকওদিক দেখে বেছে নিলাম কলেজের সামনের, কফি হাউসের উপরের বিখ্যাত দোকানের স্টল (কাকতালীয়ভাবে, রূপা-ও কফি হাউসের উপরেই ছিলো) - চক্রবর্তী ও চ্যাটার্জি।
ঢুকে শুধু কমিক্স-গ্রাফিক নভেলের সম্ভার দেখেই চোখ টেরিয়ে গেলো। ইংরেজি কমিক্স, গ্রাফিক নভেলের যে কী ভয়াবহ দাম হতে পারে, তা কন্যোজার মাত্রেই জানেন। আমরা অনেক ভেবেচিন্তে দুটো ডিসির মোটকা বই, একটা অ্যাভেঞ্জার্সের বই ইত্যাদি তুলেও রেখে দিলাম। ভয়াবহ দাম - চুরি করতে গেলে প্যাঁদানি খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর, ব্যাগ অলরেডি বিচ্ছিরি ভারি।
“ভাই, এই ডিসি আর মার্ভেলগুলো বোরোং কাল এসে লিয়ে যাবো বা। আজ এতো নেওয়া চাপ হোবে, ফেঁসে যেতে পারি বা।”
বা-র কথা শুনে ভাবলাম, ঠিকই বলেছে। বরং কাল ফাঁকা ব্যাগে এসে এগুলো তুলে নিয়ে যাবো। আজ অল্প কিছুই নিই। এইসব ভেবে তুলে নিই কয়েকটা ফ্যান্টম, আর ডিসির কিছু ব্যাটম্যানের পুরোনা ইস্যুর রিপ্রিন্ট। নিয়ে সেই চুরি করা ম্যাপের মধ্যে বইগুলো জড়িয়ে অনেক কায়দা করে ব্যাগে ঢোকালাম। মন তখন কনফিডেন্সে টগবগ করছে। উফফ, বইচুরি এতো সোজা? তাইজন্যই লোকে এরকম লাখলাখ টাকার বই ঝাড়ে। আচ্ছা, আমার মতো নভিসই যদি দিনে তিন-চার হাজার টাকার বই ঝেঁপে দেয়, তাহলে পুরো বইমেলায় সে কতো ঝাড়বে? পনেরো দিন বইমেলা হয়, পনেরো ইন্টু চার হাজার, মানে ষাট হাজার! আর একজন অভিজ্ঞ চোরাঁতেল..
গেটের সামনে একজন আটকানোতে আমার মানসাঙ্ক কষা থেমে গেলো। চোখ দিয়ে রীতিমতো কশাঘাত করে তিনি সোজা বললেন, “ব্যাগ খোলো।”
আমি অবাক, বিস্মিত, আহত, ব্যাহত, নিহত, সুভা (রবিঠাকুর দ্রষ্টব্য), যামিনী রায়ের আঁকার ন্যায় বড়ো বড়ো আয়ত চোখদুটো মেলে তাঁর দিকে তাকালাম। কিন্তু কাকু স্ট্রেট ছিলেন, ফলে স্ট্রেটকাট আমাকে আবার ব্যাগ খুলতে বললেন, আমার স্টেয়ারে বিন্দুমাত্র কেয়ার না করে।
আমি ব্যাগ নামিয়ে একটা অন্য চেইন খুলে তাঁকে দেখালাম। তিনি বললেন, “ওটা না। পিছনের চেইনটা খোলো।”
আমি বুঝলাম, পতন অবশ্যম্ভাবী। কামাল করতে গিয়ে বামাল ধরা পড়তে চলেছি। ধরণী, আর্থকোয়েক ইত্যাদি করে দ্বিধাটিধা হও…
ধরণীর ভারি বয়ে গেছে। সে দিব্যি নট-নড়ন-চড়ন-ঠকাস-মার্বেল ভঙ্গিতেই রইলো। আমি কলিযুগকে গালাগাল দিতে দিতে অভিশপ্ত পিছনের চেইন খুললাম।
খুলতেই কাকা ছোঁ মেরে ম্যাপে জড়ানো বই আর আমাদের নিয়ে সোজা কাউন্টারে।
“ধরেছি, এই যে। অনেকক্ষণ ধরে এদের ওয়াচ করেছি। এবার ব্যবস্থা হবে এদের।”
আমার তখন বুক এবং আরো অনেককিছুই ফাটছে। কিন্তু সেসব বাইরে বুঝতে দেওয়া যাবে না। এদিকে বা আমার হাত ধরে কেঁদে উঠেছে, “ভাই, এ কী করলি বা? এবার হামাদের তো জেলে দেবে বা! আমার পিতাজী-মাম্মি তো মোরে (ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নহে) যাবে বা! হামি তো আর জোব (চার্নক নহে) পাবো না বা…”
এসব মড়াকান্না শুনে ওকে এক কড়া ধাতানি দিয়ে বললাম, “তুই থাম। আমি দেখছি।”
কী যে দেখছি, তা আমিই জানি। চোখে শুধুই সর্ষেফুল দেখছি তখন। কিন্তু ওই হতচ্ছাড়াকে না থামালে মুশকিল। মহা গেরো!
ওদিকে কাউন্টারের লোকটা আমাকে মোটামুটি ‘বাংলায় তস্করতা ও তার প্রতিকার’ শিরোনামের একটা রচনা শুনিয়ে দিলো।
“হ্যাঁ, ইয়ার্কি পেয়েছো? তোমরা বাচ্চা ছেলে, জানো না চুরি করা কতো খারাপ? অর্থশাস্ত্রে তস্করতার জন্য প্রাণদণ্ডের নিদান পর্যন্ত দেওয়া আছে। আমাদের কতো ক্ষতি হতো বলো তো? তোমাদের তো হাতও পাকেনি। এখন চুরির ফলে তোমরা বড়ো হয়ে ঘুষখোর হবে, নেতা হবে। জাতীয় আয়ের কতো শতাংশ চুরি করা ধন, জানো?”
তখন ওসব বিজাতীয় কথা শুনতে বয়েই গেছে। আমি হ্যাঁ হ্যাঁ, আসলে স্টুডেন্ট তো, ভুল হয়ে গেছে ইত্যাদি করে ম্যানেজ দিচ্ছি। ওদিকে বা-হতচ্ছাড়াটা সমানে “পিতাজী হামার কী হোলো গো” “মাম্মি হামাকে তুমি শমা (ক্ষমা) করে দিও, হামি তোমার মুখ ডোবালাম” “বোন তোর এই দাদা অমানুষ” “দাদাজী হামি একটা ব্লেকসিপ” এসব র্যান্ট করে চলেছে। অন্যসময় হলে ওকে ঠাটিয়ে দুটো থাবড়া মারতাম। সেটাও পারছি না।
কাউন্টারের সামনে মোটামুটি ভিড় লেগে গেছে। আমাদের রাজ্যে এই জিনিসটার অদ্ভুত চল। টিসি যদি ডাব্লুটি-কে ধরে, অথবা ট্রাফিক পুলিশ কোনো আইনলঙ্ঘনকারীকে, বা এক্ষেত্রেও, বইচোর মানে আমাদের ধরা হয়েছে - সেখানেই সব ভিড়, সব এফোর্ট। ওদিকে সেই ফাঁকে হাজারো ডাব্লুটি, বা হেলমেট ছাড়া বাইক, বা অন্য কোনো বইচোর দশগুণ বেশি বই নিয়ে কেটে পড়লো - এতে তাদের কিছু এসে যায় না। সবাই মজা দেখছে।
“ছিঃ, এই আমাদের সমাজ!”
“আহারে, গরিব দুটো ছেলে। শুধু বইই তো পড়তে চেয়েছে। বিদ্যার কি কোনো দাম হয়?”
“কেউ গরিব না। ওরা নির্ঘাত পাকা চোর। পুলিশ ডাকো।”
“পুলিশ কিচ্ছু হবে না। গিল্ডের লোক ডাকো।”
“গিল্ড ডেকে কী কচুপোড়া হবে শুনি? সব বোঝেন?”
“তুমি সব বোঝো?”
“তবে রে ব্যাটা ইস্টুপিট!”
হেব্বি একটা ঝামেলা বেধে গেলো।
এক সিকিউরিটির লোক এসে দেখি, আমাদের দিকে ফোন তাক করে ছবি তুলছে। আমি স্বভাববশত পোজ দিতে গিয়ে বুঝলাম, এক্ষেত্রে ঠিক হবে না। আর বা ক্যামেরা দেখেই পাপারাজ্জি দেখা নায়িকার মতো ভেঙে পড়লো। নিজের বাবাকে ফোন মেরে দিলো সঙ্গে সঙ্গে -
“পিতাজী হামাকে খোমা কোরে দিন। হামি পারলাম না।”
“....”
“না না, হামি সুসাইট কোরছি না। হামি ধোরা পোড়েছি। আপনার মুখ রাখতে পারলাম না পিতাজী। এবার জেলে দেখা হোবে।”
“....”
“না পিতাজী, না। গোয়না না। বোই চোরি কোরেছি হামি আর ওর্চি। মা সরোসসোয়াতি তাই হামাদের পাপ দিলেন পিতাজী।”
“...”
“না পিতাজী, বেল কোরানোর কোনো দোরকার নেই। হামি এটা ডিজার্ভ কোরি। হামাকে খোমা কোরবেন। আপনার বেটা একটা ব্লেকসিপ।”
আমি আর নিতে না পেরে ওর থেকে ফোনটা কেড়ে নিলাম। বললাম,
“ভাই, কী শুরু করেছিস? থামবি না মার খাবি?”
“না ভাই, হামার গিল্ট হামাকে কামড়ে খাচ্ছে। হামি পারছিনা ভাই।”
“তোর গিল্ট তোকে চেটেচুষেকামড়ে যেভাবেই খাক, যদি ড্রামা না থামাস, তোর গিল্ট বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে তাড়াবো। চুপ করবি?”
ঝাড় খেয়ে থামলো।
রচনাকাকু আরেকটা রচনার স্ক্রিপ্ট ভাঁজছিলেন। ভাবলাম, এখনই রাস্তা।
“কাকু..”
“বলো? ক্ষমাটমা হবে না। চোররা এ সমাজের… “
“কাকু প্লিজ না। আপনি এর থেকে মারুন, কিন্তু আর এরকম বলবেন না। হাতজোড় করছি!”
কাকু বিরক্ত হলেন, দিয়ে থামলেন। রচনার প্রয়াস চটকে গেলো বলে খুবই চটে গেলেন বলে মনে হলো।
আমি লোহা ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই আবার হাতুড়ি চালালাম - “কাকু, আমরা পে করে দিচ্ছি। কথা দিচ্ছি, এমনটা আর হবে না। আমরা ভদ্রঘরের ছেলে, একটু অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে করে ফেলেছি। বিশ্বাস করুন।”
বা হঠাৎ “মামাজী” বলে ডুকরে উঠলো। রচনাকাকু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যাঁ? তোমার মামা আমি?”
“না না কাকু। হামার মামা খুব সোত ইনসান বা। সে জোখোন জানবে তার ভাঞ্জা এইসন করিয়েছে, তোখোন সে কী কোস্টো পাবে বা…”
এসব বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি আবার তেড়েমেড়ে গালাগাল দিতে যাচ্ছি, তখন রচনাকাকু বললেন, “আহা, কেঁদো না। মামার কথা আগে ভাবা উচিত ছিলো। ঠিক আছে, তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। দাম দিয়ে দাও। কোনো ডিসকাউন্টও দেবো না।”
আমি চমৎকৃত হলাম। আরিব্বাস, হতচ্ছাড়ার কান্নায় চিঁড়ে ভিজবে জানলে তো মালটাকে কেলিয়ে কাঁদাতাম। যাইহোক, আমি তখন সব টাকা দিতে রাজি। ডিসকাউন্ট? পারলে আমিই ওনাকে মার্জিন মানি দিয়ে আসি ওর উপরে।
পকেট হাতড়ে, ক্যাশ-ডেবিটকার্ড মিলিয়ে সমস্ত টাকা বিলিয়ে দিলাম - Bill-ইয়ে দিলাম। এই Bill-আসিতার ফলে একেবারে ট্যাঁকখালির জমিদার হয়ে বেরোলাম। মাথা নিচু। উল্টোডাঙা স্টেশন হেঁটে ফিরতে হবে - অটোর ভাড়াও নেই। হাঁটা লাগালাম।
“ভাই, কালকে তাহোলে হামরা বোই চুরি কোরতে কিন্তু আর আসবো না।”
কড়া চোখে বায়ের দিকে তাকিয়ে একটা অনুচ্চারিত গালাগাল গিলে নিলাম।
Comments
Post a Comment