'আমারে বাঁধিছে রাদিচে..'
উইলিয়াম রাদিচে আর আমাদের মধ্যে নেই। জানতে পারলাম, দু'দিন আগে তিনি চলে গিয়েছেন। বাঙালির কাছে 'শুধুই বাঞ্ছারাম' মনোজ মিত্রের মৃত্যুসংবাদকে ছাপিয়ে তাঁর প্রয়াণের খবর ফেসবুক অ্যালগরিদমে জায়গা করে নিতে পারেনি। স্বাভাবিক। গেঁয়ো যোগীই যেখানে ভিখ পায়না, নাম-না-জানা বিলিতি যোগীর চলে যাওয়ার খবরে সেখানে আহাউহু না হওয়াটাই কাম্য।
তবুও, রাদিচেকে হয়তো অনেকেই চেনেন। যাঁরা চেনেন, জানি না তাঁদের কাছে রাদিচের গুরুত্ব কতটা। হিসেব মতো, আমার কাছেও থাকা উচিত নয়। জেভিয়ার্সখেদানো-প্রেসিতাড়ানো আমার মতো সামান্য পাঠকছাত্রের উপর রাদিচের প্রভাব ঠিক ততখানিই হওয়ার কথা, যতটা প্রভাব বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ভার্সেই চুক্তির ছিলো।
কিন্তু আমার সৌভাগ্য, সম্ভবত রাদিচের দুর্ভাগ্যও, রাদিচের সঙ্গে আমার পরিচিতি হয়ে যায়। আমার মতো মূঢ় মানুষ কোনোদিনই তাঁকে খুঁজে পেতো না, যদি না আমার জীবনে ড. ঋতম্ মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন প্রফেসর থাকতেন।
থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন। পঞ্চম সেমিস্টার। মধ্যযুগের অকূল পাথারে ভরাডুবি হয়ে আধুনিক সাহিত্যে এসে একটু হাঁপ ছাড়ছি সবে। সিলেবাসে রবীন্দ্রনাথের উপর একটি পেপার ছিল, যার মধ্যে একটি মডিউল ছিল রবীন্দ্র কবিতা। মডিউলটি ঋতম্বাবু পড়িয়েছিলেন।
'সোনার তরী' পড়ানোর কথা একদিন। ক্লাসে এসে স্যার সবার আগে ধরেছিলেন রাদিচে। আমি বুঝভুম্বুল। কী জ্বালা, এখন অনুবাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ পড়ব কেন? কী দরকার এসবের? আচ্ছা ঝামেলা তো!
ভাগ্যিস পড়িয়েছিলেন স্যার। ভাগ্যিস স্যার রাদিচের সঙ্গে আলাপ করিয়েছিলেন। নয়তো সারা জীবন ট্রান্সলেশন স্টাডিজের সঙ্গে পরিচিতি হত না। জানতে পারতাম না, কীভাবে একটা প্রাইমারি টেক্সটকে ভেঙেচুরে তার যথার্থ অনুবাদ করতে হয়। অনুবাদের ভাষা ও প্রাইমারি টেক্সটের ভাষার মধ্যে যোগসূত্র কীভাবে তৈরি হয়, কীভাবে লেখক বা অনুবাদকের ছাপ পড়ে ভাষাকে ছাপিয়ে যাওয়া ভাবের মধ্যে, সেসব কিচ্ছু শিখতাম না। রাদিচে-অনূদিত 'গোল্ডেন বোট' এবং রবীন্দ্রনাথের স্ব-অনূদিত 'গোল্ডেন বোট'-এর মধ্যে ফারাকটাও জানতে পারতাম না। জানতে পারতাম না, কেন রাদিচে পাটনীকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক করে তুলেছেন। একটা নতুন দিক খুলে দিয়েছিলেন স্যার, এবং অবশ্যই, রাদিচে।
তারপরে বিস্তর ঘেঁটেছি রাদিচে নিয়ে। স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে ট্রান্সলেশন স্টাডিজ নিয়ে। ডিসার্টেশন করার কথাও ভেবেছিলাম স্যারের কাছে, জাপানি সাহিত্য এবং বাংলা অনুবাদের উপর। স্যার প্রবল উৎসাহ দেওয়া সত্ত্বেও, গাইড হিসেবে স্যারকে না পাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
ঋতম্বাবু, এবং সর্বোপরি রাদিচে না থাকলে অনুবাদ ব্যাপারটাকে কোনোদিনই অন্য চোখে দেখতে পারতাম না, বা ডিসিপ্লিন হিসেবে ট্রান্সলেশন স্টাডিজের মাহাত্ম্য বুঝতাম না৷ আমার মতো তুচ্ছ মরমানুষের জীবনে এই পাওয়াগুলোই বা কম কী?
ভালো থাকবেন, রাদিচে। আপনার ভূমিকা আমার সাহিত্যচিন্তন গড়ে ওঠার পিছনে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝাতে আমি ক্লাসে একটা মজার কথা বলতাম - 'আমারে বাঁধিছে রাদিচে।'
Rest in peace. :)
Comments
Post a Comment