বড়ো হয়ে বড়ো হব

আজ নাকি আমাদের, মানে ছোটোদের দিন। সবার কতো ভালো কথা! অন্যদিনগুলোয় ছোটোদের কী অপমান, কী অপমান! একটা কথা যদি শোনে কেউ আমাদের!

 


আরে, ছোটো হওয়া কি ইয়ার্কি নাকি? তোমরা, মানে বড়োরা যে আমাদের এভাবে হতচ্ছেদ্দা করতে থাকো, বোঝো ছোটো হওয়া কত কঠিন? হয়ে দেখেছো কখনো ছোটো? 


তোমাদের যখন বলি, বারান্দায় ঘ্যাঁঘাসুর বসে আছে ঘাপটি মেরে, বেরোতে গেলেই ধরবে, তোমরা বিশ্বাস করেছো? হেসে উড়িয়েই দিয়েছো। কী? না, এসব নাকি হয় না। বললেই হলো? আগেরদিন দীপু মা শীতলার দিব্যি কেটে বলল, ওর বাড়ির বারান্দায় সন্ধে থেকে ঘ্যাঁঘাসুর এসে বসে থাকে। ও মিথ্যে কথা বলেছে, বলো? মা শীতলার দিব্যি কেটে ও মিথ্যে বলবে? বেশ, না হয় বলল। কিন্তু বোসদের পোড়ো আমবাগানটায় যে ঘোলু আর ভোলু বলে দুটো কন্ধকাটা থাকে, সেটা তো সত্যি মানবে? ও মা! তাও দেখি মানো না। বাবাকে বলতে গেলাম, বাবা খুব গম্ভীর মুখে শুনে 'হ্যাঁ, এখন কাজ করছি, বিরক্ত করো না' বলে তাড়িয়ে দিল। কী মুশকিল, ওই আমবাগানের পাশ দিয়েই তো বাবা ফেরে। মানুষের ভালো কি আর করতে আছে? বুঝবে ঠ্যালা, একদিন ঘোলু-ভোলু লম্বা হাত বাড়িয়ে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে গেন্ডুয়া খেলুক। তখন না মেনে থাকে কী ভাবে, দেখব। সব কাজ বেরিয়ে যাবে!


সেদিন দূরের যে লম্বা রাপুঞ্জেলের প্রাসাদটা, যেটাকে দাদা সমানে বলতে থাকে ফোনের টাওয়ার - কী বোকা দেখেছো? - সেটার উপর একটা বিরাট পাখি বসেছিল। দাদাকে যত বলছি, ওটা সিন্দবাদের রক, দাদা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে। বলছে ওটা নাকি চিল। মানে আছে কোনো, বলো? কলেজে পড়ে আর গোঁফ গজিয়েছে বলে কি সব জেনে গিয়েছে? বেশি হাসুক, আমিও বাড়িতে বলে দেবো ও লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট টানে। আমি স্পষ্ট দেখেছি, মাক্কালী! ওর ব্যাগে দেশলাই বাক্সও দেখেছি আমি। বড়ো হয়ে গেলে মানুষ বোধহয় এসবই করে! 


এই যেমন, সেদিনকার কথা। ক্লাসে আন্টি জিজ্ঞেস করছিলেন, কে কী হতে চাও বড়ো হয়ে। প্রতীক, আমাদের ফার্স্ট বয় কী একটা বলল আইএস না কী। আন্টি শুনে খুব খুশি! কে জানে ভাই, কী ওটা! আমাকে তো বাপু জিজ্ঞেস করাতে আমি সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, রঘু ডাকাত। বলেই ক্ষান্ত হইনি, মুখে হাত চাপা দিয়ে হা-রে-রে-রে বলে হাঁক পেড়েও দেখালাম। ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়ে উঠল! তোমাদের চুপিচুপি বলি, কাউকে বলো না যেন - দুপুরবেলায় ঠাম্মি ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি একা একা বাগানে গিয়ে অনেকদিন ধরে এটা অভ্যেস করে করে শিখেছি। ঘোঁতনকে আগেরদিন শোনালাম - ওর চোখগুলো গুল্লি-গুল্লি মার্বেলের মতো হয়ে গিয়েছে শুনে। অথচ, কী অদ্ভুত, আন্টির মুখটা কীরকম রাগী-রাগী হয়ে গেল - দাদুর টেবিলে একটা বাঘের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার আছে, অনেকটা ওরকম। আন্টি বললেন, বাড়ি থেকে যেন মা-বাবাকে নিয়ে দেখা করি। খবরটা মা-বাবাকে বলতেই ওদের মুখটাও কেমন ওই রাগী বাঘটার মতো হয়ে গেল। কারণ জানতে চাওয়ায় পুরোটা বললাম। শুনে বাবা-মা নিজেদের মধ্যে গজগজ করতে থাকল, আমি নাকি কীসব 'ফ্যান্টাসি' বই পড়ে এমনটা হয়ে যাচ্ছি। কী বলে, বুঝি না বাপু। 


তা বাবা-মা গেলো। প্রিন্সিপাল ম্যাম, আন্টি, বাবা, মা - সবাই রাগী বাঘের মতো মুখ করে বসে। মায়ের মুখটা যদিও মাঝে মাঝে আমাদের পাড়ার হুলোটার মতো হয়ে যাচ্ছিল, যাকে দেখলেই মনে হয় এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। তাই দেখে আমি ফিচফিচ করে হেসে ফেলছিলাম বলে বাবা এক ধমক লাগাল। ওরা কীসব বলল, আমি অত শুনিনি। আমি তখন জানলার বাইরে আকাশ দেখছিলাম। ওদিন পাঁচটা আইস্ক্রিম মেঘ, দুটো গাড়ি, ছটা ব্যাং আর তিনটে কচ্ছপ মেঘ যেতে দেখলাম - আমি পরিষ্কার গুণেছি। আমি কর ধরে ওয়ান, টু করে করে গুণতে পারি। এর মধ্যেই কানে আসছিল, ওরা 'আনমাইন্ডফুল' 'ডেড্রিমিং' 'ইম্ম্যাচিওর' 'নন-সিরিয়াস' কীসব যেন বলছে। তারপর আমাকে ডেকে বলা হল, আমাকে নাকি প্রতীকের পাশে বসতে হবে, কারণ ও আইএস হতে চায়। 


কী জ্বালা! এই আইএসটাইএস কেন হবো আমি? তাকে নাকি সবাই ভয় পায়, শ্রদ্ধা করে। আরে, রঘু ডাকাতকেও তো সবাই ভয় পায়! ভাবো, কত সাহস হলে চিঠি পাঠিয়ে জমিদারবাড়ি ডাকাতি করতে যায়। সবাই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। আর শ্রদ্ধা পেতে হলে ক্যাপ্টেন স্কট হবো! এমনিতেও আমি ভেবেইছি, আমি আর ঘোঁতন মিলে আটলান্টিস আর এলডোরাডো খুঁজে বের করব। এই যাহ, তোমাদের বলে দিলাম! আসলে এটা সিক্রেট তো খুব! আমাদের এখানে নন্দীদের যে পুকুরটা আছে, ওই পুকুরের তলা দিয়ে সোজা আটলান্টিসে যাওয়া যায়। ঘোঁতন একদিন সাঁতার কাটতে গিয়ে তলায় একটা টানেল দেখেছে, যার ওদিক দিয়ে আলো আসছিল। আমি আর ঘোঁতন ডুবুরির পোশাক বানাচ্ছি রেনকোট কেটে। হয়ে গেলেই আমরা বেরোব। আর সেসব ছেড়ে, আমি হব নাকি আইএস? প্রতীকটা এক নম্বরের বাজে ছেলে। কিচ্ছু জানে না ও। হেডউইগের ছবি দেখে নাক সিঁটকে বলেছে, এ নাকি এমনিই লক্ষ্মীপ্যাঁচা, এদিকে খুবই পাওয়া যায়। ও আসলে এসব কিচ্ছু পড়েনি। ওর মা আসলে খুব রাগী। সারাক্ষণ পড়তে বসায় ওকে। তার পাশে বসতে হবে আমাকে?


তাহলেই দেখো, আমাদের কতো কষ্ট। আমাদের কে বোঝে? কেউ কিচ্ছু মানতে চায় না। পাড়ার শেষ বাড়িটা যেটা, যেখানে কেউ থাকেনা আর সারাবছর থাকে, ওখানে যে রাতে ভূতে নাচ করে 'হিং হ্যায়, তেল হ্যায়, ইমলি হ্যায়, লসুন হ্যায়' বলে, আর মানিক কুঁজ নিয়ে গেলে তার কুঁজ ফেলে দেয় - এটাও কেউ মানতে চায় না। সবাই বকা দেয়। আমাদের বাড়িতে ভাত খায় যে মেনিটা, ওটাই যে আসলে মজন্তালী সরকার - এটা সব্বাইকে কতবার বলেছি। শুনলে হাসে সবাই। আমি তো বাবা ওকে দেখলেই 'পেন্নাম হই মহারানী' বলি। কী দরকার, রাজার কাছে নালিশ করে যদি?


আর বড়ো হলে কত সুবিধে! শুধু সবার উপর চেঁচিয়ে যাও, বকে দাও। যার যার উপর রাগ হচ্ছে, তার উপর চেঁচাতে না পারলে ছোটো কাউকে ধরে বকে দাও। ওদের ভাবতে হয়, কাল স্কুলের পাশের দোকানটায় ড্র‍্যাগনবলজির স্টিকারগুলো শেষ হয়ে গেলে কী হবে? বা রমেন কাকুর দোকানে যে কুড়িটা রিফিল দেওয়া পেন বিক্রি হয়, যেটা রমেন কাকু এনে দেবে বলেছে, ওটা না এনে দিলে স্কুলে মুখ দেখাতে পারব কিনা? ওদের শুধু চেঁচামেচি করলেই হল, বকলেই হল। 


 ধুর ধুর। ঠিক করে নিলাম, আমি বড়ো হয়ে বড়োই হব। ছোটো হওয়া খুব কঠিন।

Comments

Popular Posts