ভালো-বাসা
আজকে আমার এক বান্ধবীর স্টেটাসে তার নব-নব প্রেমজীবনের একটি ক্ষুদ্র বিম্ববিশেষ দেখলাম। তার প্রেমিক তার ব্যাপারে কিছু গদগদ কথা লিখেছে, আর সে সেটার স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্ট করেছে। সেই স্টেটাসে মিলেমিশে ছিল প্রেমের নিশ্চুপ গর্ব, অধিকারবোধের ভালোলাগা, প্রথম স্পর্শের শিহরণ। মজার ব্যাপার, হয়তো খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকও - এককালে এই বান্ধবীটিকে আমার ভীষণই ভালো লাগত, এবং তার কথা অনুযায়ী, তাকে প্রথম ‘প্রেমপত্র’-ও নাকি আমিই লিখেছিলাম।
তার স্টেটাসটা দেখে মনটা ভারি ভালো হয়ে গেল। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে আসতে ইচ্ছে করে না। প্রতিটি পোস্টেই সবাই সর্বক্ষণ গরলোদ্গীরণ করে চলেছে। নিজেদের যাবতীয় ইনসিকিওরিটি, হীনম্মন্যতা, জীবনজগতের সমস্ত খারাপটাই শুধু সমাজমাধ্যমে উঠে আসছে। প্রবল, প্রবল তিক্ততা। সেই তিক্ততা-অসূয়া-পরশ্রীকাতরতা-হিংসা-ঘৃণার পূতিগন্ধে সমস্তকটা ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রয়েছে মিম-রিল-’শিটপোস্টিং’-এর আড়ালে চটুল-অবান্তর-নিরর্থক রসিকতা। মানুষের রুচিবোধ, সুকুমার বৃত্তিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন - অন্তত এমনটাই মনে হয় আজকাল।
একই সঙ্গে রয়েছে প্রেমের প্রতি তীব্র বিবমিষাবোধ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তিক্ততার চশমাজোড়া দিয়ে জগতের সমস্ত প্রেম বিষবৎ ঠেকে মানুষের কাছে। সেইজন্যই ‘১৪ ফেব্রুয়ারি জোড়ায় দেখলেই ঢিল ছুঁড়ব’, ‘রাত জেগে মেসেজ করিস না, ও ঠিক কেটে যাবে’ শীর্ষক পোস্ট সমাজমাধ্যম ছেয়ে থাকে সর্বক্ষণ। হাহা দিয়ে ভরে থাকে সেইসব পোস্ট। সেই হাসিগুলোও বড্ড ফাঁপা শোনায়। এতো ঈর্ষা, এতো রিরংসা মানুষের মনে! সবাই সবাইকে সারাক্ষণ ঠকাবে, সবাই সারাক্ষণ সবাইকে আঘাত দেবে, পালাবে, অত্যাচার করবে, মন ভাঙবে… অনেককে এমনও বলতে শুনেছি, ‘যাকে চিনিনা-জানিনা, সে ইনস্টাগ্রামে ক্লোজড স্টোরিতে জোড়ায় জোড়ায় ছবি দিচ্ছে! বিরক্তিকর, ধরে ব্লক করে দিয়েছি!’ এতো অসহিষ্ণু আমরা?
ঠিকই, জীবন ফুলেল বিছানা নয়। তাতে কাঁটা আছে বিস্তর। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, কাঁটা আছে বলে, নেতিবাচকতা আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। খারাপ বলে যদি কিছু না থাকত, ভালো মুহূর্তগুলোর আস্বাদন এতোটা সুস্বাদু হত না। বোনলেস চিলি চিকেন সুস্বাদু, কিন্তু একঘেয়ে। মাংসের হাড় চিবোনোর মধ্যেই প্রকৃত রসাস্বাদন থাকে। একঘেয়েমি থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দেয় এই খারাপগুলো।
এই অজস্র খারাপ-হিংসার মধ্যেই আমার বান্ধবীর করা ওই পোস্টের মতো ঘটনাগুলো বড্ড মন ভালো করে দেয়। এখনো মানুষ স্বপ্ন দেখে, প্রেমে পড়ে। ঘর বাঁধে, ভালোবাসে, ঝগড়া করে, অভিমান করে। অভিমান ভাঙায় উল্টোদিকের মানুষটা, সেটা জেনেই অভিমান করে।
এইসব দেখলে নিজের ফেলে আসা সুখস্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। প্রথম প্রেমের দিনগুলো, অজস্র অপেক্ষা, মানঅভিমান, স্বপ্ন দেখা একসঙ্গে, বোকা বোকা আচরণ, মনে থেকে যাওয়ার মতো হাস্যকর এবং অ্যাডভেঞ্চারাস কোনো কাজ, মানুষটাকে দেখার জন্য ক্লান্ত, ঘুমন্ত পায়ে অনেকটা দূর যাওয়া, তাকে দূর থেকে এক ঝলক দেখলেই অদ্ভুত প্রশান্তিতে মনটা ভরে আসা…
সেইসমস্ত অনেক, অনেক পিছনে ফেলে রেখে এসেছি। মানুষের জীবনে প্রেম একবারই আসে, প্রেমের মতো প্রেম - যা জীবনকে দেয় মাহাত্ম্য, আর্তকে দেয় আশ্বাস, আহতকে দেয় বেদনার উপশম। আমার জীবনেও তা এসেছিল, কালের নিয়মে তা চলেও গিয়েছে। প্রেমের পূর্ণতা গোছের একটা অদ্ভুত হিসেব অনেকেই কষে - কিন্তু প্রেম মাত্রেই পূর্ণ, তার আবার কীসের পূর্ণতা? ৬ দিন হোক, কি ৬ বছর, কি ৬ জন্ম - প্রেম মাত্রেই প্রেম। ফুরিয়ে গেলে পরে সেই প্রেমেরই দরজা হাসিমুখে বন্ধ করেও দিতে হয়, দিয়েওছি তা। টুকরো স্মৃতির চন্দনকাঠের বাক্সে ঝুল পড়তে থাকে। তখনই এই সমস্ত পোস্ট চোখে পড়ে। আবার হাতড়ে হাতড়ে সেই চন্দনকাঠের বাক্স নামাই। ঝুলটুল ঝেড়ে সযত্নে রাখা স্মৃতিগুলোকে উলটেপালটে দেখি। নতুন প্রণয়ীযুগলের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই, নিজের ফেলে আসা সময়কে। ভালোলাগায় দ্রব হয়ে ওঠে মন। ভালো হয় যেন ওদের। সবার ভালো হোক। যারা ভালোবাসে, তাদের ভালো হোক। প্রেম মহার্ঘ্য বস্তু, তা যেন বেঁচে থাকে এভাবেই - যুগে যুগে, সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে বদলে। প্রেম আছে বলেই মানুষ আছে, এই প্রবল এবং তথাকথিত দুঃসময়ের মধ্যেও মানুষ আছে। সেই প্রেমকে দেখলে যারা দূর থেকে দাঁত কিড়মিড় করে, শাপশাপান্ত করে, নারী-পুরুষবিদ্বেষী নানা তর্ক তুলে এনে মানুষের মনকে বিষিয়ে দেয় - তাদের দেখলে করুণা হয়। বড্ড করুণা হয়।
ভালো থাক ওরা। ভালো থাকুক ভালোবাসা। এই দমবন্ধকর সমাজে ওদের, এবং এরকম আরো অনেকের শত-শত ভালোবাসা অক্সিজেন দিতে থাকুক নিয়ত। আর হিংসুটেদের জন্য তো ইয়াব্বড় কাঁচকলা রয়েইছে! 🙂
Comments
Post a Comment