আমেজী ভালোবাসা, ফুল ফোটার কাল, ফুলেলা কিছু বছর - ওয়ং কার-ওয়াইয়ের নান্দনিকতার ভাষ্য
[ডিসক্লেইমার - ১) আমি ফিল্ম স্টাডিজের লোক নই, কোনো বোদ্ধাও নই। নিজের যেটুকু বোধ, তার উপরে ভিত্তি করে লেখা। ফলে, কোনো বক্তব্য থাকলে সরাসরি বলবেন।
২) ফিল্ম রিভিউ জিনিসটা আমার ফোর্টে নয় (সে কিছুই ফোর্টে নয়, এফোর্টে হতে পারে বড়োজোর)। ফলে, একটু বড়ো হয়ে গিয়েছে, এবং সম্ভবত ইনকোহেরেন্টও। ক্ষমাঘেন্না করে পড়ে বক্তব্য জানালে খুশি হব।]
ভালোবাসার কি সত্যিই বিশেষ ‘আমেজ’ থাকে? সমস্তটা জুড়েই কি ভালোবাসা নয়? নাকি, মুহূর্তের পর মুহূর্ত বুনে তৈরি হয় ভালোবাসার পশমি অস্তিত্ব? ভালোবাসা কি সামগ্রিকতা নাকি খণ্ডযাপন? সময়ের নিক্তিতে কি তীব্রতা মেপে নেওয়া যায় ভালোবাসার? ভালোবাসা ঠিক কতটা রঙিন, কতটা মোনোক্রোম, কতটা গ্রেস্কেল? আদৌ উচ্ছ্বাস, নাকি স্থবিরতা?
এরকম হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে আসছিল ওয়ং কার-ওয়াইয়ের তর্কাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয়তম সিনেমা ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ দেখতে বসে। সিনেমাটা প্রথম দেখেছিলাম পাক্কা দশ বছর আগে। স্কুলে পড়তাম তখন, সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি। মাথায় ভূত চেপেছে সিনেমার। সারাদিন গোগ্রাসে সিনেমা গিলে যাচ্ছি। কিছু সিনেমা বুঝে, অধিকাংশই না বুঝে বা নিজের মতো করে বুঝে… তখনই, হাজারো ক্লাসিক সিনেমার ভিড়ে এই সিনেমাটাও দেখেছিলাম। প্রথম দেখায়, অবশ্যই, ভালো লাগেনি। ষোলো বছরের অপরিপক্ক্ব মাথা নিতে পারেনি ওয়ং কার-ওয়াই। তবে, সিনেমার বর্ণময়তা ভালো লেগেছিল, এইটুকু পরিষ্কার মনে আছে।
আবার যখন সিনেমাটা কিছুদিন আগে, এক বৃষ্টিমুখর বিষণ্ণ দিনে দেখতে বসলাম, তখন মাঝখান দিয়ে কেটে গিয়েছে দশটা বছর। গ্রামার ভাঙা শিল্পের সৌন্দর্য নিয়ে অল্পসল্প ধারণা জন্মেছে। পিকাসো-দালি-ম্যাগরিটের কাজ দেখেছি, দেখেছি বুনুয়েল-দুশঁর কাজ, পড়েছি সার্ত্র-হাক্সলি-মার্কেজ। প্লটের গঠন নিয়ে ধারণা জন্মেছে, ধারণা জন্মেছে উত্তর-অবয়ববাদ, উত্তরাধুনিকতা নিয়ে। খুবই উপরউপর ধারণা, তবুও। যদিও, সিনেমা দেখতে গেলে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা কী - এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিই হয়তো বলবেন, সিনেমা আসলে কবিতার মতো। যা বুঝবে তুমি, যা দেখবে, তাই-ই সিনেমা। আমার সেই ব্যাপারটায় একটু আপত্তি আছে। বেশি ডিটেইলে না গিয়ে এটুকুই শুধু বলার, ব্যাকরণ না বুঝলে ব্যাকরণ ভাঙা কেন হচ্ছে - এটা বোঝা যায় না। এসব কচকচি এখানেই থাক বরং।
সিনেমাটা দেখতে গিয়ে যেটা টের পেলাম, একটা জিনিস দশ বছর আগের সঙ্গে একইরকম ভাবে মিলে যাচ্ছে - বর্ণময়তার প্রতি মুগ্ধতা। ইন দ্য মুড ফর লাভ-এ বিষণ্ণ ভালোবাসার যে রঙিন উদযাপন হয়েছে, সেটার মতো অদ্ভুত কনট্রাস্ট খুব কম আছে। এই কনট্রাস্ট থেকেই উঠে আসে ড্রামাটিক কনফ্লিক্ট, বা নাট্যদ্বন্দ্ব। সেসবে পরে আসছি।
সিনেমাটির গল্প (বা গল্পহীনতা) খুবই সাধারণ। ষাটের দশকের শুরুর কথা, ঘটনাস্থল হংকং। প্রধান কুশীলবেরা হচ্ছেন এক সওদাগরি আপিসের মালিকের সেক্রেটারি সু লি-ৎসেন/মিসেস চ্যান (ম্যাগি চেয়ুং) আর এক সাংবাদিক চাও মো-ওয়ান (টোনি লেয়ুং)। মিসেস চ্যান এবং মিস্টার চাও দুজনেই একটি সস্তাগোছের অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া নিয়ে উঠবেন,পাশাপাশি ঘরে। দুজনেই বিবাহিত, দুজনের সঙ্গীই চাকরিসূত্রে জাপানে রয়েছে। হঠাৎই দুজনে আবিষ্কার করবেন, তাঁদের সঙ্গীরা একে অপরের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ। সত্যিকে মেনে নিতে পারা আর না-পারার দোলাচল এবং এক শীতল শূন্যতাকে একটু উষ্ণ আঁচে ভরে নেওয়ার জন্য তাঁরা একে অপরকে সঙ্গ দেন। তাঁদের সম্পর্ক কী কী মোড় নেবে, সেটাকে ঘিরেই সিনেমাটা মূলত এগিয়েছে (বা এগোয়নি?)
ওয়ং কার-ওয়াই-এর সিনেমার একটা প্রধান বিশেষত্ব হল ছকের মধ্যে থেকে ছক ভাঙা। অ-সরলবৃত্তীয় আখ্যান (নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ) নিয়ে সিনেমায় যাঁরাই কাজ করেছেন, তাঁরাই তাঁদের শৈল্পিক স্বাধীনতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে গিয়ে বহুক্ষেত্রে চলে গিয়েছেন অবস্কিওরিটির দিকে, কখনো বা জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন নিজের ন্যারেটিভ। তার ফলে ব্যাহত হয়েছে সিনেমার স্বাভাবিক গতি। মনের চেতনাপ্রবাহের সঙ্গে তাল মেলাতে সবসময়ে পারেনি রিলের চেতনা-আখ্যান। এখানে দাঁড়িয়েই ওয়ং কার-ওয়াই শিখিয়ে দিচ্ছেন, পরিমিতিবোধ কতটা দরকার।
ইন দ্য মুড ফর লাভ মূলত কোলাজধর্মী সিনেমা। নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভে যা মূলত হয়, অর্থাৎ কোনো বিশেষ দৃশ্যক্রম থাকে না। আগের ঘটনা, পরের ঘটনা, মাঝের ঘটনা… এসব কিচ্ছু নেই। সবটাই রয়েছে, আবার কিছুই নেই। নিজের মতো করে বসিয়ে নাও। গদারের সিনেমা, বিশেষ করে ‘প্রেইজ অফ লাভ’ দেখলে এটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। গদার নিজেও বলে গিয়েছেন সেই বিখ্যাত কথাটি - ‘আ স্টোরি শ্যুড হ্যাভ আ বিগিনিং, আ মিডল অ্যান্ড অ্যান এন্ড, বাট নট নেসেসারিলি ইন দ্যাট অর্ডার।’ ‘ইন দ্য মুড…’-এও মোটামুটি একই জিনিস প্রায় দেখা যায়। একের পর এক সিন তৈরি হচ্ছে - জীবনানন্দ ধার করে বলা যায়, ‘তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’। অজস্র কোলাজ জুড়ে একের পর এক মঁতাজ শট (ব্রজদার ভাষায়, মন তাজা করে দেয় যা), দ্রুত দৃশ্যপটের পরিবর্তন - এককথায় যাকে ‘সিনেমাটিক ব্রিলিয়ান্স’ বলা যায়।
১৯৬৩-এর সময়ের ঘটনা দেখালেও মনে রাখতে হবে, সিনেমাটি ১৯৯০-এর দশকে তৈরি। বিশ্বায়নের খোলা বাজারের যুগ। পৃথিবী যত কাছাকাছি আসছে, মানুষের মধ্যে দূরত্ব তত বাড়ছে। ৯০-এর দশকের এই একাকীত্বকে ওয়ং বসাচ্ছেন ১৯৬০-এর দশকে। ভালোবাসা নামক ইনস্টিটিউশনের যে প্যারাডাইম শিফট, তাকে দুটো টাইমস্কেপে একইসঙ্গে প্লেস করতে গেলে সময়-কালের কাটাকুটি গ্রিডের ব্যাপারে প্রবল ধারণা থাকতে হয়। ওয়ংয়ের সেটা যথেষ্টই ছিল।
সিনেমাটির অনেকগুলো বিশেষ দিক রয়েছে। প্রথমত, রঙের ব্যবহার। ওয়ং কার-ওয়াইয়ের সিনেমার প্রতিটা ফ্রেমে রঙের ব্যবহার যে ঠিক কতখানি ভিভিড, উজ্জ্বল, বর্ণময় - সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সমালোচককে এককালে দেখেছিলাম, মার্ক রথকোর ছবির সঙ্গে ওয়ংয়ের সিনেমার তুলনা করতে। এর থেকে ভালো তুলনা বোধহয় সম্ভবত আর হয় না। প্রতিটা দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই কালার ফিল্ড, এবং বহুক্ষেত্রেই অত্যন্ত আনইউজুয়াল কালারস্কেপ - এর তুলনা খুবই কম। ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’-এ এই কালারস্কেপ অত্যন্ত অদ্ভুত একটা কনফ্লিক্ট তৈরি করেছে, যেটার কথা বলছিলাম। দুটো অত্যন্ত একলা মানুষ, যারা একাকীত্ব থেকে পাথর হয়ে গিয়েছে প্রায় - যারা নিজেদের জন্য রান্নাটুকুও করতে চায় না, যাদের নুডলস কেনার মধ্যেও অদ্ভুত একাকীত্ব মিশে আছে - তাদের ওয়ং কার-ওয়াই সাজিয়ে দিচ্ছেন লাল দৃশ্যপটে। লাল, অর্থাৎ ভালোবাসার রং। উষ্ণতার রং। চাউ আর সু-এর মধ্যে যে উষ্ণতাটা আসবে আসবে করছে, কিন্তু এসে পৌঁছোয় না - তাদের সাদাকালো জঞ্জালে ভরা জীবনে যে লাল রঙের প্রবল অভাব, ব্যাকগ্রাউন্ডে অন্তত ওয়ং তার কোনো অভাব রাখেননি। প্রেম আছে এবং প্রেম নেই - এই দুয়ের এক অদ্ভুত বর্ণময় কনফ্লিক্টে ভর করেই সিনেমাটা গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলে।
প্রসঙ্গত, এই বর্ণময় প্রেম দেখে আরেকটা সিনেমার কথা হয়তো মনে পড়তে পারে - দামিয়েন শ্যাজেলের বিখ্যাত মিউজিকাল রোমান্টিক কমেডি লা লা ল্যান্ড। এমা স্টোন-রায়ান গসলিং এর সম্পর্কের রসায়নেও এই রঙের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা আছে। লা লা ল্যান্ড যেমন নৃত্যছন্দে এগিয়েছে, তেমনই এগিয়েছে ইন দ্য…-ও। ওয়ং নিজেই তাঁর এই সিনেমা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘টু পিপল ডান্সিং টুগেদার স্লোলি’। ঠিক এই কথাটাকেই আমরা কি ‘লা লা ল্যান্ড’-এর দুটো গান, ‘সিটি অফ স্টারস’ আর ‘আ লাভলি নাইট’-এ ফেলতে পারিনা? তবে, দুটো সিনেমার মধ্যে ফারাকও বিস্তর। ইন দ্য মুড ফর লাভ-এর বিষণ্ণতা কখনোই প্রাণোচ্ছ্বলতায় পর্যবসিত হয় না; লা লা ল্যান্ড-এ প্রাণোচ্ছ্বলতা থেকে বিষণ্ণতার একটা রুটবদল বরং দেখা যায়। লা লা ল্যান্ড-এর থিম্যাটিক রং নীল - আসন্ন বিষণ্ণতার ইঙ্গিতবাহী; ইন দ্য-এর থিম্যাটিক রঙ লাল, একটা অপ্রাপ্তিজাত উষ্ণতার প্রতীকস্বরূপ, আর কিছুক্ষেত্রে সেপিয়া - বিবর্ণ স্মৃতির প্রতিফলন।
সিনেম্যাটোগ্রাফির দিক থেকে এই সিনেমা মোটামুটি টেক্সটবুকের কাজ করতে পারে। দুই বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার এই সিনেমায় কাজ করেছেন - একজন ওয়ং-এর দীর্ঘদিনের সঙ্গী সিনেমাটোগ্রাফার ক্রিস্টোফার ডয়েল, আরেকজন মার্ক লি পিং বিন - তাইওয়ানিজ সিনেমায়, বিশেষ করে তাইওয়ানিজ নিউ ওয়েভ সিনেমার এক অন্যতম পথপ্রদর্শক হৌ সিয়াও-সিয়েনের সঙ্গে ‘ফ্লাওয়ার্স অফ সাংহাই’, ‘মিলেনিয়াম মাম্বো’, ‘থ্রি টাইমস’-এর মতো কাজ করেছেন। ডয়েলের দ্রুতগতির ছোটো ছোটো শট, ক্লোজ শট, আনইউজুয়াল নানা অ্যাঙ্গলের শট আর লি পিং বিন-এর লং শট, তাক লাগানো একেকটা প্যানিং শট - এই দুই চালডাল মিলিয়ে কী স্বাদু খিচুড়ি যে ওয়ং বানিয়েছেন, তার তুলনা সত্যিই বিরল। সু আর চাউয়ের বিভিন্ন দৃশ্য তোলা হয়েছে এমন একেকটা অ্যাঙ্গল থেকে, যাতে মনে হয় চুরি করে তাদের জীবনে উঁকি মারা হচ্ছে। সত্যিই কি তাই নয়? শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল, ‘গসিপ’-এর বিষয় না হওয়ার। নাকগলানো বাড়িওয়ালি মিসেস সুয়েন, চাউয়ের মদ্যপ ও লম্পট বন্ধু পিং - তাদের জীবনে মাথা গলানোর লোকের অভাব হয়নি। জনবহুল হংকং শহর, ব্যস্ত হংকং শহর - তাও, দুটো একা মানুষের নিজস্ব, ব্যক্তিগত স্পেসের অভাব। এক ছাতার তলায় হাঁটলে, এক ঘরে কাটালে, এক ট্যাক্সিতে করে ফিরলে, নিভৃতে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেও অলক্ষ্যে থাকা সদাসতর্ক চোখ নজর রেখে যাবে, ঠিক যেটা ক্যামেরা তুলে ধরতে চেয়েছে। ঝাপসা, আউট অফ ফোকাস, পিপ-ইন করা - অথচ, অন্যের জীবনে মাথা গলানো। সু প্রথম থেকেই বলে গিয়েছিল, ‘আমরা ওদের (তাদের স্বামী ও স্ত্রী) মতো হব না।’ হায় রে ভাগ্যের পরিহাস! হায় রে একাকীত্ব!
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আসপেক্ট বাদ দিলে এই সিনেমার কথা কিচ্ছুটি বলা হবে না - তা হল ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। যে সিনেমা ‘মুড’-এর কথা বলে, সেই সিনেমায় মুডনির্ভর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর হবে না, তা হতেই পারে না। ট্রাডিশনাল চিনে অপেরার ব্যবহার বাদ দিলে মূলত চারটে স্কোরের জন্য এই সিনেমা অমর হয়ে থাকবে - জাপানি কম্পোজার শিগেরু উমাবায়াশির ‘ইউমেজিস থিম’, আর মার্কিন জ্যাজ গায়ক, ব্যারিটোন কণ্ঠের ন্যাট কিং কোলের গলায় ‘আকুএওস ওহোস ভেরদেস’ (ওই সবুজ চোখদুটি), ‘তে কিয়েরো দিহিস্তে’ (তুমি বললে, ‘ভালোবাসি তোমায়’) আর ‘কিজাস, কিজাস, কিজাস’ (বোধহয়, বোধহয়, বোধহয়)। ইউমেজি’স থিম-এ বেহালার করুণ, বিষণ্ণ, একাকীত্বের আর্তির সঙ্গে চেলোর গম্ভীর, ‘শূন্যতা’র দৃপ্ত অথচ মন্দ্রোচ্চারণ মিলে যে এক অদ্ভুত মনখারাপের হারমোনি তৈরি করেছে, তার যথাযথ ব্যবহার করেছেন ওয়ং। সু-এর একাকী নুডলস কিনতে যাওয়া, চাউয়ের একা একা দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টেনে যাওয়া, বৃষ্টিভেজা রাস্তায় সু আর চাউয়ের একসঙ্গে ভেজা, আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়া, হাতদুটো একমুহূর্তের জন্য আশ্লেষে চেপে ধরে ছেড়ে দেওয়া - সমস্তটা জুড়ে বাজতে থাকে ইউমেজিস থিম। সু ভেজে, চাউ ভেজে, দ্রব হয় দুই হৃদয়, কাছে আসতে না পেরে রক্তাক্ত হয় - আর ভিজতে থাকি আমরা, দর্শকেরা। স্নাত হই দুজনের অবরুদ্ধ কান্নায়। কখনো কখনো আমাদের কান্না বেরিয়ে আসে সু-এর মতোই, শুধু আলিঙ্গনের জন্য কাঁধ পেতে দেয় না কোনো চাউ। ফাঁকা পড়ে থাকে হোটেলের ঘর, সময়ে এসে পৌঁছোনো হয় না। অস্থির অস্থির লাগতে থাকে, হাতছাড়া হয়ে যায় সমস্ত সুযোগ, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে ন্যাট কোল কিং ব্যঙ্গ করে যান ‘কিজাস, কিজাস, কিজাস!’... পারহ্যাপস, পারহ্যাপস, পারহ্যাপস বলে। মিলতে পারেনা দুটো হৃদয়, আর সম্ভাবনার তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের আঘাতে আঘাতে দীর্ণ করে দেওয়া হয়, সমাজের নৈতিকতার সদাজাগ্রত-সদাভিজিল্যান্ট চোখের দৃষ্টিশরে শেষ করে দেওয়া হয় সমস্ত সম্ভাবনা - দিয়ে গাওয়া হয় সম্ভাবনার গান।
সব মিলিয়ে, ইন দ্য মুড ফর লাভ ওয়ং কার-ওয়াইয়ের নান্দনিকতার এক ন্যারেটিভ। না এতে গল্প বিশেষ আছে, না প্লট, না বলিষ্ঠ অভিনয়ের সুযোগ - শুধু রয়েছে জ্যাকসন পোলকের প্যালেটের মতো রঙের খেলা, এডওয়ার্ড হপারের ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে পিয়েট মন্ড্রিয়ানের সিটিস্কেপ, আর নেরুদার কবিতা। সমস্ত গ্রামার ছেড়ে, তত্ত্ব ছেড়ে, চুপ করে মাথা নত করে বসতে হয় এই সিনেমাকবিতার কাছে, যেখানে দুটো হৃদয় চেয়েছিল এক হতে, একে অপরের কাছে আসতে, ভালোবাসতে, বৃষ্টিভেজা এবং ঠকে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে হৃদয়কে প্রেমের দেশলাই ঠুকে উষ্ণ করে নিতে - কিন্তু, ফুরিয়ে যায় সব। সমস্ত আমেজ, সমস্ত মুড, সমস্ত সময়… ফেলে আসতে হয় ভালোবাসাকে, এগিয়ে যেতে হয়। আর, গোপন কথাকে পাহাড়ের মাথায় গাছের গায়ের কোটরের মধ্যে বলে মাটি চাপা দিয়ে দিতে হয়। বোতলবন্দী করতে হয় আবেগকে, দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।
অনেকেরই দেখা নির্ঘাত। যদি একান্তই দেখা না থাকে, তবে দেখেই ফেলুন।
(বিচ্ছিরি পোস্টারটি নিজের অতিকাঁচা হাতে বানানো। ক্ষমা প্রার্থনীয়।
ইন দ্য মুড ফর লাভ x মনে x নেরুদা)
Comments
Post a Comment