উৎসবে-ব্যসনে চৈব (ed.)
আগেরদিন অনলাইনে একটা আর্টিকল পড়ছিলাম, যার মুখ্য বিষয় হলো কীভাবে উৎসবের হরষের গভীরে লুকিয়ে থাকে গোষ্ঠীক অবসাদ। অবসাদের মাত্রা যত গভীর হয়, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আড়ম্বর, ভিড়, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। বিশেষত, কোভিডের প্রকোপের ফলে যে প্রজন্মগত ট্রমা সামাজিকভাবে আমাদের পঙ্গু করে দিয়েছে, তারই বশে কোভিড-পরবর্তী পুজোগুলোর ধুমধাড়াক্কা আরো বেশি।
বিশ্বায়ন-পরবর্তী যুগে, মূলত এই নয়া পুঁজিবাদের যুগে মানুষ নিজের অজান্তেই হয়ে পড়েছে কেবলই একটি রাশিবিজ্ঞানের আইডেন্টিটি, একটি সংখ্যা। কেবলই একজন ভোক্তাবিশেষ - এর বাইরে তার পরিচয় নেই। সুকৌশলে সেটাকে মুখোশ পরিয়েই যে পরিচিতিটা তুলে ধরে এই নয়া-পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, তা হল ইন্ডিভিজুয়াল, ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে একজনের পরিচয়। এইসবের টানাপোড়েনের ফলে আমরা ক্রমশ যে 'বিশেষ' হয়েছি, তাই শুধু নয় - আমরা হয়ে পড়েছি চূড়ান্ত, চূড়ান্তভাবে একা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে একদিকে আমাদের সংযোগ বেড়েছে, অপরদিকে আমাদের নিজেদের মধ্যে মানসিক ব্যবধান যোজনবিস্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে আস্তে আস্তে। আমরা এর আগে এক বদ্ধতার মধ্যে থাকলেও, বেঁধে বেঁধে থাকতাম। একটা কৌমপরিচিতি ছিল আমাদের। বিশ্বায়ন এসে সেই পরিচিতি-রাজনীতির মূলে আঘাত হেনেছে, ঘটিয়েছে এক অদ্ভুত প্যারাডাইম শিফট।
কোভিডের মতো বিশ্বব্যাপী সঙ্কট আসার ফলে আমরা বহির্বিশ্ব থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হই। ফিরে আসতে হয় ঘরে, নিজের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে চার দেয়ালের মধ্যে - যাদের মধ্যে দূরত্ব মাপতে বোধহয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপও পারবে না। আবার আমরা ফিরে আসি সভ্যতার ফিরতি পথে, পরিচিতিসঙ্কটের শিকার হই - যাদের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তাদের সঙ্গে দিনগুজরান - ব্যক্তিক ও গোষ্ঠীক পরিচয়ের অদ্ভুত সংঘাত। ফলে, খুঁটিনাটি কারণেই ঝগড়া, বিরক্তি। বরফ গলা তো দূর, বরফ জমতে থাকে - বাড়তে থাকে একাকীত্ব। বাইরের জগতের কোভিড-সংক্রান্ত উদ্বেগ, অস্তিত্বের একরকম সঙ্কট, আর ভিতরের জগতের পরিচিতি সঙ্কট - এই দ্বিমুখী আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে এক অনন্ত কুয়োর মধ্যে তলিয়ে যাই আমরা, গিলে খেতে থাকে এক অদ্ভুত ট্রমা।
এই ট্রমা-পরবর্তী সময়েই আমরা দেখছি, যেকোনো উৎসবে, যেকোনো সামাজিক স্ফিয়ারে আমাদের যোগদানের উৎসাহটা তুলনামূলকভাবে বেশি - সেটা পুজোর প্যান্ডেলে হোক, ক্রিসমাসের পার্ক স্ট্রিটে হোক, বা তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে পথে নামাতেই হোক। প্রসঙ্গত, ফেসবুকে একজন লিখেছেন, বোধন শব্দের মধ্যেই বোধ লুকিয়ে থাকে - এবং দেবীর বোধনের আগেই কলকাতায় লক্ষাধিক জনসমাগম সেই বোধের অভাবেরই পরিচায়ক। আমি নিজেও সেই মতাদর্শেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যে বাঙালি এবং ভারতীয় মাত্রেই হুজুগে বিশ্বাসী। কিন্তু, তবুও, কোথাও গিয়ে যেন একটু হলেও মনে হয় যে, এই উৎসবের হুজুগগুলো, বিশেষ করে এই পরিস্থিতিতে খুব একটা নিরর্থক নয়।
মানুষ আসলে একা থাকতে ভালোবাসে না। এই একাকীত্বটা শুধুমাত্র যে দশটা মানুষের সঙ্গে গলাজড়াজড়ি করে বসে থাকা, তা নয় - এই একাকীত্বটা belongingness-এরও। এই কারণেই দেখা যায়, কোনো পপুলার টিভি সিরিজ, কোনো সিনেমা, কোনো বই (যদিও বই নিয়ে মাতামাতিটা ডাইনোসরের সঙ্গেই উল্কার বাড়ি খেয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে) বা যেকোনো নতুন অভিজ্ঞতার একটা সামাজিক চাপ কাজ করে, যেটাকে peer pressure-ও বলা হয়। ফলে দেখা যায়, মার্ভেল দিয়ে গুলি করে না মার্ভেলাস মারামারি করে, এইটুকুও না জানা মানুষটা মার্ভেলের নতুন সিনেমা দেখতে চলে যায়, ফ্যান্টাসি বলতে পাশের বাড়ির বৌদির বেশি ভাবতে না পারা লোক গেম অফ থ্রোনস দেখে নিচ্ছে, ডিজনিল্যান্ডকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ ভাবা লোকজন শ্রীভূমিতে ভূমিহীনের ন্যায় জড়ো হয়েছে। এমন না, যে এগুলো না দেখলে-না করলে লোকে জাতে উঠতে পারবে না। বরং, এগুলো না করলে সে বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে পড়বে। এই আলাদা হয়ে পড়া, এই একাকীত্ব, এই একলা হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ মানুষকে বোধশূন্য করে তোলে, তাকে হুজুগে মাতিয়ে তোলে।
অনেকেই মনে করেন, যাদের ব্যক্তিত্বের অভাব, যাদের নিজস্বতার অভাব, তারাই এই পিয়ার প্রেশারের চাপে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে, হয়ে যায় ট্রেন্ডসর্বস্ব, ভেড়ার ন্যায় herd mentality-ময়। কিছুটা হয়তো তা সত্যিই। কিন্তু, 'আমি ট্রেন্ডের সামনে মাথা নিচু করবো না' এই মর্মে অনেকেই হয়ে গেছে চূড়ান্ত একা। বাকিদের থেকে আমি আলাদা, স্রোতের বিপরীতে আমাকে যেতেই হবে - এই জেদ করে স্রোত থেকেই চ্যুত হয়ে গেছে কতশত মানুষ। অথচ, একটু যদি 'আমিত্ব'কে দূরে সরিয়ে রেখে তার কালেক্টিভ সত্তাকে প্রশ্রয় দিতো, তাহলে হয়তো এতোটাও খারাপ সময় আসতো না। ক্ষুদ্র আমিগুলোকে কখনো কখনো বৃহৎ আমিগুলোর সঙ্গে, সামাজিক আমিগুলোর সঙ্গে, গোষ্ঠীক আমিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হয় - নিজের স্বাতন্ত্র্যের স্বার্থেই - কেন না, মনে রাখতে হবে, মানুষ আসলে একা থাকতে পারে না, এবং চায়ও না, তা কাম্যও নয়।
এখন আবার উৎসবের মরশুম। অদ্ভুত কিছু মনখারাপ গ্রাস করে থাকে আমাদের যাপন। কেউ কেউ সেটা ভুলতে বেরিয়ে পড়ে ভিড়ের মধ্যে, যদি ধাক্কাধাক্কির চোটে সেসবকে দূর করে দেওয়া যায় - আর অল্প কিছু মানুষ থাকে, যারা নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ, একাকী - এই সমস্ত শহরের সবকটা ভিড় একসঙ্গে মিলেও তাদের মনখারাপের মলম হয়ে উঠতে পারে না৷ অদ্ভুত এক বোধ খেলা করে চলে তাদের মধ্যে। এই পুজো, উৎসব তাদের জন্য নয়। তারা শুধু এই আলোকোজ্জ্বল শহরের ছায়া-উপচ্ছায়ার কোণে বসে নিজেদের মনখারাপের বিনিসুতো গেঁথে চলে, আবার দিনদশেক পরের ধূসর বিষণ্ণতার শরিক হওয়ার জন্য। আসলে, উৎসব বড়ো নিষ্ঠুর। উৎসব মানুষকে যেমন কাছে আনে, তেমনই তাদের মধ্যেকার ফাঁকগুলোও বড্ড নির্মমভাবে হাইলাইট করে দেয় - বুকের মধ্যে শূন্যতা খাঁ খাঁ করে, যে অতলস্পর্শী হওয়ার মতো ডুবুরি হওয়া আর কারোর হয়ে ওঠে না।
(বছরখানেক কি দুয়েক আগে পুজোয় লেখা। একটু এডিট করে পোস্টানো)
Comments
Post a Comment