হান কাং, নোবেল ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে দু-চার কথা


সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্যিক হান কাং। আমি যেহেতু ফেসবুকের নেমড্রপিং আঁতেল বা তুলনামূলক সাহিত্যের পড়ুয়া (নিন্দুকেরা বলে দুইই সমান, কান দেবেন না ওসবে) নই, ফলে তাঁর লেখা পড়িনি। সত্যি বলতে, তাঁর নামটা পর্যন্ত এর আগে শোনা ছিল না। দুদিন আগে দ্য গার্ডিয়ানের একটা প্রেডিকশন পোল পড়ছিলাম, যেটা অনুযায়ী জেতার দৌড়ে সবথেকে এগিয়ে ছিলেন চিনের ক্যান শুয়ে, আর্জেন্তিনার সিজার আইরা, অস্ট্রেলিয়ার গেরাল্ড মার্নেন, মার্কিন টমাস পিঞ্চন, আর অতিপরিচিত দুজন - মার্গারেট অটউড এবং প্রিটেনশাসদের গডফাদার হারুকি মুরাকামি। হান কাং তালিকাতেই ছিলেন না। কিন্তু, বিগত সমস্ত প্রেডিকশনেই আমরা এক্সিট পোলকে ফেল মেরে যেতে দেখেছি, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 


হানের জেতার খবর পেয়ে একটা কেজো আর্টিকল লিখতে বসে ঘাঁটাঘাঁটি ইত্যাদি করছিলাম। দুর্ভাগ্যই বলা চলে, ভদ্রমহিলা যে ২০১৫ সালে ম্যান বুকার পেয়েছিলেন, সেই খবরটাও জানা ছিলো না। তবে নির্ঘাত জানি, যে উপন্যাসের জন্য তিনি ম্যান বুকার পেয়েছিলেন, 'চেসিকজুইজা' বা 'দ্য ভেজিটেরিয়ান' - সেটা এখন ফেসবুকজুড়ে অনেকেরই প্রিয়তম উপন্যাসের তালিকায় থাকবে। ঠিক দুদিন আগেই তারা পড়ছিল উপন্যাসটা, বা কেউ কলেজে থাকতেই পড়েছিল, পড়ে মুগ্ধ হয়েছিল এবং ভেবেছিল যে এরকম লেখা কেন নোবেল পায় না - পুরস্কার নামক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানকে ধিক-ধিক-ধিক্কার ইত্যাদি।


ভদ্রমহিলা সঙ্গীত ও শিল্পের রীতিমতো কনোইজার যাকে বলে। অনুরাগিনী। তাঁর লেখাতে বিশেষভাবে প্রচুর রেফারেন্স উঠে আসে, এবং একটা অদ্ভুত শিল্পচেতনা দেখা যায়, এমনটা অনেকেরই মত। বিশেষত, তাঁর 'গেউদাইউই চাগাওন সোন' বা 'ইয়োর কোল্ড হ্যান্ডস'-এ এটা বিশেষ করে দেখা যায়। এক স্থপতির নেশা, ধ্যানজ্ঞান, মোহাবিষ্টতা - সবই হচ্ছে নারীদেহের প্লাস্টারকাস্ট বানানো। মানবদেহের অ্যানাটমি এবং আর্ট - এই দুইয়ের আলোচনাকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, সেটা প্রচণ্ডই রেনেসাঁ যুগের কথা মনে করিয়ে দেয় কিছুক্ষেত্রে। এক স্থপতির মনের দ্বন্দ্ব - মানবদেহের দৃশ্য ও অদৃশ্য নিয়ে - শরীর কী দেখায়, শরীর কী লুকোয় - এই নিয়ে এক অদ্ভুত আলো-আঁধারির সংঘাত। প্রসঙ্গত, রেমব্রান্টের অ্যানাটমি লেসন অফ নিকোলাস টুল্প ছবিটার কথা মনে পড়তে পারে অনেকের। যাইহোক, না পড়া উপন্যাস নিয়ে অকারণ জ্ঞান দেওয়া উচিত হবে না। তবে, রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি এই উপন্যাসের ইংরিজি অনুবাদের যে লাইনটা তুলে দিয়েছে তাদের বিবৃতিতে, সেটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না -  “Life is a sheet arching over an abyss, and we live above it like masked acrobats.”।


হানের লেখা সম্পর্কে যা পড়লাম, যেটুকু উলটেপালটে দেখার সুযোগ হল, তাতে এটাই বোঝার, যে হানের সাহিত্য মূলত অন্তর্জগতের। মনোজগতের। শরীর-মনের যে ক্লাসিক দেকার্তীয় দ্বৈততা, তা তুলে ধরা এবং তার পাশাপাশি দুয়ের মধ্যে এক অনবদ্য সাঁকো তৈরি করা, তার সঙ্গে এক অদ্ভুত কাব্যিক গদ্যশৈলী - এতে হান অদ্ভুতরকমের পারদর্শী। বিশেষত আমরা যখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এতোটা সচেতনতা ছড়ানোর চেষ্টা করছি চারপাশে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লেখার অভাব তুলনামূলকভাবে চোখে পড়ার মতো। ম্যাক্রো ঘটনার মাইক্রো প্রভাব নিয়ে অনেকেই মাথা ঘামান, লেখেন। কিন্তু তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কীভাবে মনোজগতের ধূসর জায়গাগুলোকে প্রভাবিত করে, সেগুলো নিয়ে আমরা লেখালিখিতে অতটা ভাবিত নই। দুঃস্বপ্ন দেখে মাংস খাওয়া বিষয়ক ট্রমা, মাংস ছেড়ে নিরামিষাশী হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া, তার ফলে নানাবিধ কনসিকোয়েন্সেস - এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবি আমরা কেউ? কীভাবে আপাত ছোটো ছোটো ঘটনা মানসিক বিকলন ঘটাতে পারে, পর্যুদস্ত করে দিতে পারে সবকিছু, ওলটপালট করে দিতে পারে আমাদের জীবনজগৎ সবকিছু - সাহিত্যে তার প্রতিফলন এখন কই? বিশেষ করে, বাংলা সাহিত্যে? 


এক্ষুণি হয়তো কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক দাড়ি নেড়ে এবং কাফকা-কামু ঝেড়ে কিছু বাতেলা দেবে এসে, কেন নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমেই উৎকর্ষতা হয় না, কেন তাদের ক্ষুদ্রতম, সংকীর্ণতম গণ্ডির ম্যাগাজিনেই একমাত্র বাংলা সাহিত্যের আসল অস্তিত্বসংকটের আসল ধারাটা লুকিয়ে রয়েছে, বা সমাজ পালটে দেওয়ার চাবিকাঠি। অনেকেই বলবেন, বাংলা সাহিত্য এখন কর্পোরেটাইজড। কিছু হাঙ্গররূপী বৃহদাকার প্রকাশনা সংস্থা পুরো বাজারটা চালাচ্ছে, বাকিরা পাত্তা পাচ্ছে না, আর চলছে চূড়ান্ত ফেভারিটিজম, লবির খেলা ইত্যাদি। ঠিকই, কিছু ক্ষেত্রে তা নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমরা, বাঙালির মতো একটা চূড়ান্ত অধঃপতিত জাত, ভুলেও নিজেদের দিকে একবারও তাকাব না। ভাবব না, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রকাশনা সংস্থা এবং রক্তবীজকে কমপ্লেক্স দেওয়া নব্যলেখকগোষ্ঠী বইমেলা এলেই কিছু না কিছু ছাপতে থাকে। দুটো লাইন লিখতে পারে কি পারে না (বেশিরভাগই পারে না, সেটা আলাদা), গাঁটের কড়ি খরচা করে সেলফ-পাবলিশড বই বের করতে বেরিয়ে পড়ে সবাই। 


আর, বাংলা বাজার এখন রাজ করছে চেনা কিছু রিপিটিটিভ জনরা - হয় তন্ত্র, নয় অদ্ভুত সব প্রেমের গল্প, নয় জঘন্য কবিতা, নয় থ্রিলার, নয় ঐতিহাসিক, নয় পৌরাণিক - অথবা এদের মধ্যেকার পারমুটেশন নিয়ে লড়ে চলা। মানে, পৌরাণিক-তন্ত্র, প্রেম-ঐতিহাসিক, থ্রিলার-প্রেম, ঐতিহাসিক-তন্ত্র... আর কী লেখার ছিরি, কী তার বাহার! ঐতিহাসিক মাত্রেই তৎসম শব্দে এক অদ্ভুতুড়ে ন্যারেটিভ, সবাই সবাইকে 'আর্যে! ভদ্রে! রাজন! রাজ্ঞী' এসব বলে ডাকছে - তন্ত্রমাত্রেই একটা এমন চরিত্র থাকছে, যে হুটপাট বিভিন্ন তন্ত্রসার হ্যানত্যান বইয়ের থেকে র‍্যান্ডম পটল(অধ্যায়, তোলার বা ভাজার না) মুখস্থ বলে যাচ্ছে, এবং লাস্টে 'ভালোবাসাই তন্ত্র, বাকি সব যন্ত্র, আর পেটে থাকে অন্ত্র' মার্কা ক্যাচফ্রেজ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। সেখানেতে আঁভা-গার্দ ভাবব, ঠিকঠাক সাহিত্যের কথা ভাবব.. এসব কোথায়? তাও লোকে লেখার চেষ্টা করছে। দুয়েকজন এখনো ভালো লিখছেন, কিন্তু সেই লেখার সমকালীনতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রয়াস কই? সমকালীনতার বেড়াজালকে কাটাতে না পারলে কোনো শিল্পই উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছোতে পারে না, সে নোবেল পাক আর কৎবেল।


আর, পুরস্কারের প্রতি বাঙালির চিরঘৃণা তো রয়েছেই। বাঙালি মাত্রেই এক অদ্ভুত শহিদ জাত, যাদের সবাই চেপে রেখেছে, আটকে রেখেছে, জিততে দেয়নি, ফেলে দিয়েছে, ঠেলে দিয়েছে, উঠতে দিচ্ছেনা। ক্রিকেটের ময়দান থেকে চাকরির পরীক্ষা, সবেতেই বাঙালি এগিয়ে, কিন্তু লবি বাঙালিকে উঠতে দেয়নি। বাঙালি পুরস্কারে বিশ্বাস করে না, তাকে ঘৃণাভ'রে প্রত্যাখ্যান করে। (অথচ পেলে পরে মাথায় নিয়ে পরের একশো বছরের হিসেব সেটল করে নেয়, সেটা আলাদা)।


একটাই কথা। পাশ্চাত্য একমুখীনতার যুগে বহুদিন হল প্রাচ্য মাথা উঁচু করে এগিয়ে চলেছে। সিনেমা, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, অর্থনীতি সবেতেই প্রাচ্যের জয়জয়কার হচ্ছে। এশীয় হিসেবে আমাদের গর্ব হওয়া উচিত, হান এক এশীয় দেশ থেকে সাহিত্যে প্রথম নোবেল জিতলেন, যেখানকার পপ গান নিয়ে বা ড্রামা নিয়ে আমরা পাগল হয়ে যাই। অথচ, আমাদের মনে হয় না, প্রচুর ভেবেচিন্তে ব্রেইনস্টর্মিং করে, অনুভব করে কিছু লেখার কথা। এমন লেখা, যা শুধু বাজারেই কাটবে না, বরং ভাবাবেও। দরকারে দুটো লোক কম পড়বে, কিন্তু যারা পড়বে, ভালোবেসে পড়বে। সাহিত্যের প্রতি, শিল্পের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। 'লোকে পড়বে' অজুহাতে গা ভাসিয়ে দিলেই সাহিত্যিক হওয়া যায় না। আপনারা তাই সেটা হতে পারবেনও না, সেই দূরদর্শিতাও আপনাদের নেই।


প্রসঙ্গত, এর আগে এশিয়া থেকে সাহিত্যে ৮ জন নোবেল জিতেছেন। হান ৯ নং। প্রথমজনের পরে আর কেউই বাংলা সাহিত্য নিয়ে এগোনোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আসলে, লিটল ম্যাগাজিনেই আমাদের ভিত্তি, বইমেলাই আমাদের ভবিষ্যৎ কিনা!


Comments

Popular Posts