৯৫-এ 'রাজনৈতিক' টিনটিন...
২০০৪ সাল। তখন আমার বয়স ঐ বছর ছয়েক। মা-ভল্টুর(মাতামহ) কল্যাণে ছোটো থেকেই বইপোকা ও বেঁড়েপাকা হওয়ার কারণে প্রতিবছরই খড়দহ বইমেলায় যেতুম। কলকাতা বইমেলা তখন একটা দূরতম দ্বীপ, তার আভাস বা নাগাল কোনোটাই এই মফস্বলে সেভাবে সাড়া জাগাতো না। চাকরিবাকরি এবং সংসার সামলে মা-বাবার পক্ষেও নিয়ে যাওয়া হয়ে উঠতো না। ফলে, খড়দহ বইমেলাই সই। এবং, সত্যি বলতে, খড়দহ বইমেলা তখন এখনকার মতো গেঁজে যায়নি, এবং বইমেলার মলাটের ভিতর খাদ্যসংস্কৃতি মেলা হয়েও ওঠেনি। তাই দুধের স্বাদ ঘোল বা পিটুলি গোলা জল নয়, অন্তত মিল্ক পাউডারে পুষিয়ে নিতে পারতাম দিব্য।
২০০৪ সালেই সেই বইমেলাতেই প্রথম কিনে ফেলেছিলাম 'কাঁকড়া রহস্য'। কে টিনটিন, কেন টিনটিন - তার বিশেষ ধারণা ছিল না। শুধু চরিত্রগুলোর নাম কোনোভাবে জানতাম, সম্ভবত ফেলুদা পড়েই (সোনার কেল্লা - টুনটুনির নয়, টিনটিনের বই, টিনটিন ইন টিবেট ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)। তখনও বাংলা গ্রাফিক নভেলের সেরকম রমরমা হয়নি। ফলে সাধারণ বাঁধাই, সাধারণতম কাগজেই সেই বই কেনবার সৌভাগ্য হয়েছিল। অ্যাসিড-ফ্রি পেপার জিনিসটা তখনো বাংলাবাজারে আসতে ঢের দেরি। স্মৃতি খুব বিশ্বাসঘাতকতা যদি না করে, তবে সেই টিনটিনটির দাম পড়েছিল ৭৫ টাকা। এখনকার হিসেবে কিছুই না, কিন্তু ২০০৪ সালের হিসেবেও সেটি বেশ মহার্ঘ্যই ছিল। কিন্তু আমাকে বই কিনে দিতে, বইয়ে দিতে আমার মা-বাবা-ভল্টু কোনোদিনই কার্পণ্য করেনি। ৫০ টাকার নিরর্থক খেলনা চেয়ে পাইনি, কিন্তু ৫০০ টাকার বই এককথায় কিনে দিয়েছে - এমন ঘটনা যে কতো হয়েছে, গুনে শেষ করতে পারব না।
'কাঁকড়া রহস্য' সেই রাতেই উদঘাটন করে ফেলেছিলাম। নারায়ণ দেবনাথ অবধি তখন কমিকসের দৌড় আমার, সেখানে ওরকম একটা অন্য ধাঁচের জিনিস পড়ে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলুম। একবার পড়েই ক্ষান্ত হইনি - বারবার, বহুবার করে পড়ে ফেলেছিলাম বইটা। মলাট ইত্যাদি আমার পড়ার চাপে খুলেও এসেছিল রীতিমতো। রীতিমতো মজে থাকতাম কারাবুজানের রহস্যে। মজার ব্যাপার, ক্যাপ্টেন হ্যাডকেরও আবির্ভাব সেই কাঁকড়া রহস্যেই। বালুখাঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় মদের বোতলে গুলি এসে ভেঙে যাওয়ায় একটা লোক ফাঁকা রাইফেল উঁচিয়ে কীভাবে 'বেবুন শুয়োর গণ্ডার জলহস্তী গেঁড়িগুগলির ঝাঁক' বলে একদল সশস্ত্র আরবকে তাড়া করে ভাগিয়ে দিয়ে নিজের মাথায় নিজেই রাইফেলের বাঁট মেরে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে - কাঁচা বয়সে সেই অভূতপূর্ব গ্রাফিক বিবরণের যে কী প্রভাব, তা লিখে বোঝানো অসম্ভব। ওই রসে যাঁরা সিক্ত হয়েছেন, তাঁরাই বুঝবেন সে কী অপূর্ব জিনিস।
তারপরে টিনটিনের সঙ্গে বেশ বহু বছরই যোগাযোগ হয়নি। কাঁকড়া রহস্যটা মাঝে মাঝেই পড়েছি যদিও, তবে একটা সময়ের পরে সম্পৃক্ত হয়ে যায় সবকিছুই। ফলে টিনটিনপ্রীতি বেশ কমেই গিয়েছিল।
টিনটিনকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করি মাধ্যমিকের পর। ২০১৪ সালে। পাক্কা দশ বছর কেটে গিয়েছে প্রথম টিনটিন কেনার পর। তখন বাংলা গ্রাফিক নভেলের উন্নতি হয়েছে, নীরেন্দ্রনাথ চক্কোত্তি অনূদিত টিনটিন আনন্দ পাবলিশার্সের অন্যতম বিক্রীত পণ্য হয়ে উঠেছে। অ্যাসিড ফ্রি কাগজ দিয়ে, ভালো মানের মলাট এবং বাঁধাই করে তখন তার দাম শ'দুয়েকেরও উপরে। ফলে, প্রথমেই বই না কিনে অনৈতিক পথের রাস্তা নিলাম - অর্থাৎ পিডিএফ। সহজেই ২৫টা টিনটিনের বাংলা অনুবাদের পিডিএফ পেয়ে গেলাম। একদম সোভিয়েত থেকে সেই শুরু, বর্ণশিল্প রহস্যে এসে শ্বাস ফেলতে পারলাম। সে যে কী অদ্ভুত নেশা, তা কেমন করে বোঝাই? তখন সবকিছুই টিনটিনের আলোতে দেখছি। দু'কামরার ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েছে মার্লিনস্পাইক, শ্রদ্ধেয় হেডমাস্টারমশাইকে দেখে মনে হচ্ছে রাস্টাপপুলাস, ফিজিক্সের একজন স্যার তো একেবারেই প্রফেসর ক্যালকুলাস - তবে স্বভাবের দিক থেকে না যদিও, ঠাকুমাদের ফ্ল্যাটের নিচে একটা সাদা বেড়াল তখন আমার কাছে কুট্টুস (সাদা কুকুর খুঁজে না পাওয়ায় রেসিস্ট আমি রেজিস্ট করতে না পেরে সাদা বেড়াল ধরে এনেছিলাম), আমাদের হেলথ ইনশিওরেন্স করা কাকুটা জলিয়ন ওয়াগ, পাড়ায় সাইকেল ভ্যানে করে হরেক মাল বিক্কিরি করতে আসা কাকুটা অলিভিয়ের দি ফিগুয়েরা - এরকম আরো কত!
কিছুদিন পর থেকে টিনটিন সম্বন্ধে হয়ে গেলুম সম্পূর্ণ অবসেসড। বাংলাটা তো গিলে এবং গুলে খাওয়া ছিলোই, ইংরেজিটাও পড়ে ফেললাম পর পর। এগমন্ট থেকে বেরোনো লেসলি লন্সডেল-কুপার আর মাইকেল টার্নারের সেই অনবদ্য অনুবাদ আসল ভাষায় টিনটিন পড়তে না পারার দুঃখ একেবারেই পুষিয়ে দেয়। অনেকটাই যদিও পুষিয়ে দিয়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ, বাকিটা ইংরেজিতে পড়ে একেবারেই কেটে যায়। টিনটিন-ট্রিভিয়া বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে থাকি। টিনটিনের ক্যুইজ-ট্যুইজও করিয়েছি সেইসময়ে।
এই ট্রিভিয়া সংগ্রহ করতে গিয়েই কিছু জিনিস জানতে পারি, যা পরবর্তীতে আরো ভালোভাবে বোধগম্য হতে থাকে। টিনটিনের মতো রাজনৈতিক কমিকস যে খুব কমই আছে, সেই ব্যাপারটা বোঝার মতো চেতনা মাধ্যমিক-পরবর্তী সময়ে অন্তত হয়নি। সোভিয়েত দেশে বলশেভিকদের ক্রিয়াকলাপ, বেলজিয়ান উপনিবেশ কঙ্গোতে টিনটিনের 'পদার্পণ', অ্যাপারথেইড এবং নির্বিচারে প্রাণীহত্যা, মিশনারি স্কুলে পড়াতে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা 'বেলজিয়াম ইজ আওয়ার ফাদারল্যান্ড', ১৯২৯-এর গ্রেট ডিপ্রেশন পরবর্তী আমেরিকাতে মাফিয়ারাজ, আল কাপোনের মতো মাফিয়া গ্যাংলর্ডের চরিত্রকে তুলে ধরা (প্রসঙ্গত, কাপোনই একমাত্র বাস্তব চরিত্র, যাঁকে টিনটিনের পাতায় দেখা যায় - বাকি বহু চরিত্র বাস্তব চরিত্রের আদলে হলেও, নামসহ বাস্তব উপস্থিতি দেখা যায় না), মার্কিন ক্যাপিটালিজমের একটা অন্যরকম উপস্থাপনা, রেড ইন্ডিয়ান-সহ আমেরিকান উপজাতিদের প্রতি ব্যবহার, 'ব্লু লোটাস'-এ মাকডেন ঘটনার মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী জাপানের আগ্রাসী নীতিতে চিনের মাঞ্চুরিয়া দখল-এর খণ্ডচিত্র, বা পিকারোদের সঙ্গে মিলে জেনারেল টাপিওকাকে অ্যাবডিকেট করানোর মধ্যে ফরাসি কমিউনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট রেজি দেব্রের শে গেভারার সঙ্গে মিলে কাজ করা বা চিলিতে সালভাদোর আলেন্দের সরকার প্রতিষ্ঠা করার মিল - এরকম লিখতে থাকলে অনেক কিছু লেখা যায়। অনেকেই সেই নিয়ে বিস্তর কালিকলম খরচা করেছেন, আমি নতুন কিছু যোগ করব না।
টিনটিন আমাদের কাছে সম্ভবত এইজন্যই প্রিয়, কারণ টিনটিন বাস্তব। বাস্তব, কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক, কারণ ব্যক্তিগত এবং বিশ্ব - দুরকম সমস্যাই তাতে উঠে এসেছে। অ্যার্জেকে কেউ পলিটিকালি কারেক্ট বলবেন, সেটা বোধহয় নয়। শিল্পীর দায় থাকেও না। তবুও, অ্যার্জে সাহস করে তুলে ধরেছিলেন সমকালীন রাজনীতিকে, তাঁর আত্মবীক্ষা ও বিশ্ববীক্ষাকে। রাজনীতি সবকিছুই, কিন্তু রাজনীতির দ্বন্দ্বের আলো যেসকল শিল্পে এসে পড়েছে, সেইসকল শিল্পই কালের গণ্ডি পেরোতে সক্ষম হয়েছে। আজকে আবোলতাবোল বা হযবরল আমাদের প্রিয়, কারণ তা রাজনৈতিক। ব্যোমকেশ প্রিয়, কারণ তা রাজনৈতিক। অ্যাসটেরিক্স প্রিয়, কারণ তা রাজনৈতিক। রাজনীতি মানেই যে শুধু দলাদলি বা ভোটাভুটি - তা তো নয়; আরব বা আদিবাসী বা অশ্বেতাঙ্গদের সাধারণীকরণও রাজনীতি, টাপিওকা-আলকাজারের গৃহযুদ্ধ বা বর্দুরিয়ার অত্যাচারী কুর্ভি-তাশ সরকারের স্বৈরাচারও রাজনীতি। 'টিনটিন ইন সোভিয়েত'-এ বলশেভিকদের হাত থেকে পাঁউরুটি ছিনিয়ে একটা গরিব বাচ্চাকে দেওয়া - তাকে পাঁউরুটি না দেওয়ার কারণ এই, যে সে বলেছে সে কমিউনিস্ট নয় - সেটাও রাজনীতি। আমরা যতই কমফর্ট জোনে বসে থাকি না কেন, সভ্যতার শুরু থেকেই আমাদের মধ্যে রাজনীতিবোধ অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। অ্যাপলিটিকাল ধুয়ো তুলে বড়োজোর দায় এড়াতে পারি, কিন্তু শিশু-কিশোররাও যে সাহিত্য পছন্দ করছে, যে শিল্প উপভোগ করছে, তার মধ্যে রাজনীতি পরতে পরতে লুকিয়ে - এটা কীভাবে জাস্টিফাই করব?
টিনটিন অত্যন্ত, মানে অত্যন্তই পলিটিকাল। আর, সেই জন্যই, ৯৫ বছর পেরিয়েও চিরতরুণ টিনটিনকে আমরা ভুলতে পারিনা। টিনটিনের মধ্যে থেকে রাজনীতিটাকে ফেলে দিয়ে যাঁরা নেহাতই শিশুপাঠ্য কমিক্স হিসেবে পড়তেদেখতে চান, তাঁদের প্রতি সমবেদনা রইলো।
শুভ জন্মদিন, ছোটোবেলার হিরো! 🙂
Comments
Post a Comment