চেতনাপ্রবাহের আঁকিবুঁকি
একেকটা রাত অন্যগুলোর থেকে আলাদা হয়। এরকম কিছু কিছু রাত আসে, যখন এক অজানা কষ্টে কণ্ঠ দ্রব হয়ে আসে। আপনি চুপ করে শুয়ে শুয়ে কনট্যাক্ট লিস্ট হাতড়ান, আর দেখেন সবাই যে যার মত ব্যস্ত। এদিকে হয়তো আপনি দুটো কথা বলবেন বলে কাউকে খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। কথা বলতে গেলেও যে বলতে পারবেন, এমনটা নয় ; তবুও, খুঁজছেন। আপনি কথা বলার লোক খুঁজতে থাকেন, আর আপনার অনুচ্চারিত কথাগুলো ঢেকে যায় প্যাসিভ-অ্যাগ্রেসিভ ইমোজিতে।
আপনার যে আমিটা অনেকদিন আগে হারিয়ে গেছে ফিরবে না বলে, সেই আমিটাকে খুঁজতে গিয়ে আপনি একটা গর্ত খুঁড়ে ফেলেন। খুঁড়তেই থাকেন, খুঁড়তেই থাকেন। চারিদিকে চাপ-চাপ রক্তমাংস ছিটকে পড়ে, তবু আপনি ক্লান্ত হন না। শেষমেশ গিয়ে যখন একটা 'ঠং' করে শব্দ হয়, তখন উৎসাহিত হয়ে আরেকটু খুঁড়ে দেখেন, একটা কঙ্কাল অবহেলায় পড়ে আছে, যেন কোনোদিন কেউ আসবে বলে কথা দিয়ে যায়নি তাকে।
প্রবল হতাশ হয়ে যখন আপনি ঘরের দিকে মুখ বাড়ান, তখন আর ঘরটা দেখতে পান না। তন্নতন্ন করে আপনি ঘরটা খুঁজতে থাকেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা বাড়ি মিচকি মিচকি হাসতে থাকে। এই গা-জ্বালানো হাসিকে অগ্রাহ্য করে আপনি বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন, কিন্তু অদ্ভুতভাবেই, ভেতরে ঘরটা নেই। আবার আরেকটা বাড়ি, দরজা, আর তারা মিচকি মিচকি হাসছে। আপনি আক্রোশে দরজার পর দরজা খুলতে খুলতে শেষমেশ দেখেন, এক অদ্ভুত শূন্যতা। ব্যর্থ আস্ফালনে আপনি মাটিতে ঘুষির পর ঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে তোলেন হাতটাকে, আর বাড়ির পর বাড়ি, বাড়িগুলো, মিচকি মিচকি হেসে চলে। ভারী কৌতুক!
যে মেয়েটাকে ভালোবাসবেন বলে রাস্তা পেরোতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ করেই দেখতে পান, সেই মেয়েটা উল্টোদিকের ফূটপাথ দিয়ে তার প্রেমিকের হাত জড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে নিরুদ্দেশের দিকে মিলিয়ে যেতে থাকে। আপনি মাঝরাস্তায় অবাক হয়ে তাদের হারিয়ে যাওয়ার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ করে একটা লরি হুড়মুড় করে এসে আপনার ঘাড়ে পড়ে। আপনি দুটো টোকা মেরে গায়ের ধুলোরক্ত ঝেড়ে আবার তাকিয়ে থাকেন সেইদিকে, যেখান দিয়ে মেয়েটা একটু আগেই আইসক্রিম খেতে খেতে তার প্রেমিকের হাত জড়িয়ে চলে গেল। আপনি মেয়েটার মুখটা খুঁজতে থাকেন, ফোনের গ্যালারি আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকেন, দেখেন মেয়েটার মুখ নেই। মুখের জায়গাটা সাদাটে, ফ্যাকাশে - চোখনাককানভুরুঠোঁট কিস্যু নেই। আপনার ভয় করতে থাকে, আপনি ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে থাকেন।
সারিয়্যালিটি আপনাকে অবাক করে না আর। আপনি এখন অনায়াসে দালির ঘড়ি পরে, দ্যুশঁর ফাউন্টেনে পেচ্ছাপ করে, ম্যাগরিটের পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। তবুও, এই খুঁজতে চাওয়া এবং খুঁজতে গিয়ে রক্তাক্ত হওয়া এবং শেষমেশ হারিয়ে যাওয়াটা আপনার অভ্যেস হয়নি এখনো। শিখে যাবেন হয়তো। শেখার মতো অবসাদগ্রস্ততা আপনার আছে, চিন্তা নেই।
এভাবেই, একেকটা রাতকে আলাদা করে ফেলেন আপনি আরেকটার থেকে, কষ্টেদুঃখেপ্যাসিভ-অ্যাগ্রেশনের কামড় খেতে খেতে। এভাবেই, এভাবেই আপনি, আপনার অস্তিত্ব, আপনার অনস্তিত্ব, আপনার অবসাদ, মনখারাপ, দুঃখকষ্ট সবকিছু লাখ-লাখ লোকের হাততালি কোড়ায়, আর কম্যুনারিজমের শিকার হন আপনি, আর এভাবেই, এভাবেই রাতগুলো একটার থেকে আরেকটা আলাদা হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment