ঠিকানাহীন চিঠি : ২

প্রিয়তমা,


এটাও আরেকটা না পাঠাতে পারা চিঠি। এরকমভাবেই চিঠির পরে চিঠি জমতে থাকবে আমার কাছে। আমার একান্ত আপন, একান্তই নিজের আবেগগুলো জমা হতে থাকবে এই চিঠিগুলোতে। একদিন, সব জড়ো করে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দেবো সব ,সেই সঙ্গে নিজেকেও। নিজেকেই জ্বালানো তো ওগুলো, না? পোড়া ছাইগুলো দিয়ে এপিটাফ লিখবো নিজের। "এক ইজাজত দে দো বাস, জাব ইনকো দাফনাউঙ্গা,

ম্যায় ভি ওঁহি সো জাউঙ্গা..."


যাকগে। আপাতত ওসব থাকুক।



জানো, আজকাল খুব মনে হয়, এই জগৎটা খুব দ্রুত চলছে। সবাই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ে চলছে।
আর এই গতির মাঝে বেগতিক আমি তাল মেলাতে না পেরে একজায়গায় বুঝভুম্বুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশ দিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে সব। ফাস্ট। ফাস্ট। দৌড়োও, থেমো না।
এই বেমানান আমিটা শুধু মুহূর্তের টুকরোটুকরো কুড়োই। সেগুলোকে তারপর একটা থলির মধ্যে ভরি, দিয়ে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে পথ হাঁটতে থাকি।

জানো, তুমি যখন কালকে ওই ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের শাড়িটা পরেছিলে, আমার সব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। থলিটা ঘেঁটে স্মৃতিগুলো হাতড়ে হাতড়ে দেখছিলাম। অদ্ভুতভাবে তাজা এখনো, একটা গোটা বছর কেটে যাওয়া সত্ত্বেও।
মনে আছে, তোমাকে প্রথম যখন দেখেছিলাম, তুমি একটা নীল কুর্তি পরেছিলে? তোমার ব্যাচের বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। সঙ্গী ছিলো সহজাত নার্ভাসনেস, আর একটার পর একটা পুড়তে থাকা সিগ্রেট। তুমি আস্তে আস্তে এগিয়ে এসেছিলে আমার দিকে। সেটা চৈত্রমাস ছিলো না, প্রহরশেষের আলোও ছিলো না সেইসময়ে, ত্রিফলার আলো ছাড়া। তবুও, তোমার অল্প কাজলপরা চোখে আমার সর্বনাশ দেখেছিলাম। I saw myself getting burnt in those calming, gentle eyes. ওরকম অপ্রস্তুত আমিটাকে দেখেই তুমি প্রথম নীরবতাটা ভাঙলে, প্রবল ইন্ট্রোভার্ট হওয়া সত্ত্বেও।
'অন্য কোথাও যাওয়া যাক?'
চুপ করে তোমার পাশ ধরে হাঁটছিলাম। মাঝখানে ছিলো আমার সাইকেলটা। প্রবল নার্ভাস আমি ক্রমাগত বোকাবোকা প্রশ্ন করে চলেছিলাম। আর তুমি মৃদু প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে সেগুলোর উত্তর দিচ্ছিলে। একটুও বিরক্ত হওনি।

মনে আছে, আমরা তারপর একটা পুকুরধারে গিয়ে বসেছিলাম? চারপাশে লোকজন ছিলো না কোনো। শুধু হলদেটে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় উদ্ভাসিত আমরা ছিলাম। ওই ল্যাম্পপোস্টের আলোতেই তোমার মুখটা দেখছিলাম, কনে দেখা আলোয় যেমন বিবাহযোগ্যা কনেকে দেখা হয়।
চারিদিক নিশ্চুপ ছিলো। শুধু মাঝে মাঝে একঝাঁক ঝিঁঝিঁ বোকা, নার্ভাস, আনস্মার্ট, স্কুলপড়ুয়া আমিটাকে যেন ব্যঙ্গ করে যাচ্ছিলো।
আমি যতটা সম্ভব দূরত্ব রক্ষা করে বসছিলাম, যাতে অসাবধানে হাতে হাতে ছোঁয়াটুকুও না লেগে যায়। যদি তুমি খারাপ ভাবো! যদি তক্ষুণি উঠে চলে যাও!
এই যদিগুলোর জন্য অনেক আপশোস করেছি জীবনে, জানো।

নীরবতা ভেঙে কোনোমতে কাঁপা-কাঁপা হাতে তোমার দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমার লেখা প্রথম প্রেমপত্র। চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না ভালো করে সেইসময়ে। কেন জানিনা, সমানে মনে হচ্ছিলো, এই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে যেন তুমি হেসে উঠবে আমার এই কাজটাতে। বা এইধরণের বোকামো দেখে তাচ্ছিল্য করতে শুরু করবে। আজকালকার টেকস্যাভি যুগে হাতের ছোঁয়াটোঁয়ার মূল্য আছে নাকি কোনো?
অদ্ভুত ব্যাপার, বা সাধারণ ব্যাপার, তুমি হাসলে। কিন্তু তাচ্ছিল্যভরে না। যেভাবে নবসূতিকা তার সদ্যোজাতকে পরম সাবধানতার সাথে নেয়, সেইভাবে তুমি অদ্ভুত স্নেহমাখা একটা হাসির সাথে চিঠিটা নিলে,পরম যত্নে।
সেই মুহূর্তটাকে জানো, চিরকালের মতো বন্দী করে রেখে দিয়েছি মনের গোপন এক কোণে। পিকচার-পারফেক্ট বলে একটা কথা আছে না? ওই মুহূর্তে তোমাকে না দেখলে কথাটার মানেটাই হয়তো কোনোদিন ধরা দিতো না আমার কাছে।

তুমি নিলে। পরিপাটিভাবে ব্যাগের চেনটা খুলে চিঠিটা ঢোকালে। অন্য কোনো এক খাপ থেকে বার করলে একটা ফোল্ডেড আর্টপেপার। দিয়ে বলেছিলে,
'দ্যাখো,ওর ছবি। আঁকলাম।  ভালো হয়েছে না?'
আমি দেখেছিলাম। চুপ করে। তোমার ভালোবাসার মানুষটার ছবি। যে তোমাকে ভালোবাসে না। চায় না। অথচ তুমি যাকে চাও।
তোমার ভালোলাগা মানে আমারও ভালোলাগা, এমনটা হলে ভালো হতো। কিন্তু হলো না। কেন জানি না, অতটা উদার হতে পারলাম না। চুপ থেকে একটা অস্ফুট 'ভালোই' ছাড়া কিছুই বলবার ছিলো না।

তারপর আবার হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে এসে তোমাকে রিকশায় তুলে দেওয়া। যতক্ষণ না রিকশাটা একটা বাঁক নিয়ে বড়ো রাস্তা থেকে ডানদিকের গলিতে ঢুকে যাচ্ছে, ততক্ষণ রিকশাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। এই ছিলো আমার প্রত্যেক মঙ্গলবারের রুটিন।

জানো, এখনো সেইদিনটা মনে পড়ে, যেদিন পয়লা বোশেখ ছিলো, আর আমি চুপ করে তোমার বাড়ির গলির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠায় তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম,যদি একটাবার তুমি বারান্দা থেকে উঁকি মারো। একটাবার গেট খুলে বেরোও।

সব প্রত্যাশাগুলো সম্পূর্ণ হয় না। হয় না বলেই আমরা বোধহয় অপেক্ষা করি। দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়, প্রত্যাশাগুলো পূর্ণ হওয়ার আশায়। সকল নিহিলিজম ছুঁড়ে ফেলে দিই আমরা। প্রবল নাস্তিকও আস্তিক্যবাদী হয়ে ওঠে, চিঠিগুলো ঠিকানা খুঁজে পাবে, এই আশায়।

এক প্যাকেট সিগারেট উড়িয়ে যখন চুপ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, চোখের সামনে একটাই মেসেজ ভাসছিলো।
'সরি। মায়ের সাথে ঝগড়া করেছি। বেরোতে ইচ্ছে করছে না। তুমি চলে যাও।'
চলে যাও। চলে যাও। চলে যাও।

আমরা চলে আসি। চলে এসেছি। চলে যাই আমরা।

কোনো অভিযোগ করিনি কোনোদিন। অভিযোগ ছিলোও না মনে। অভিযোগ করবোই বা কোন দিক থেকে? তুমি কি আমার ছিলে? আমার হবে? চুপ করে মেনে নিয়েছিলাম।

এমনকি,তুমি যেদিন বলেছিলে, সুগার অ্যান্ড স্পাইসে দাঁড়িয়ে খেতে খেতে, যে তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না কোনোদিন, আমি সেদিনও কোনো অভিযোগ জানাইনি। নতমস্তকে মেনে নিয়েছিলাম। চুপ করে বিলটা মিটিয়ে বেরিয়ে এসে তোমাকে রিকশায় তুলেও দিয়েছিলাম। তাকিয়েও ছিলাম রিকশাটা মোড় ঘোরা পর্যন্ত।
হয়তো আমারও মোড়টা ঘুরে গিয়েছিলো।
তারপর থেকে এই গতকাল যাবৎ তোমার সাথে আর দেখা করিনি। ফোন নাম্বার, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, যতভাবে মানুষ যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করতে পারে,ততভাবেই করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ভুলে যাবো। পারলাম কই? কালকে নিয়তি তোমাকে আবার পাঠালো, ওই ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের শাড়িটা পরিয়ে। আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। এইভাবেই বোধহয় নিয়তি আমাদের সাথে পরিহাস করে যায় কখনো কখনো।
নাহ্। অনেক কথা বলে ফেললাম। তুমি এগিয়ে যাও তোমার মতো। এই সদা চলমান জগৎে দৌড়োতে থাকো, যত জোরে পারো। আমার তো আছেই, স্মৃতি ও মনখারাপের সেই পুরোনো ঝুলিটা। যেটা থেকে দরকার পড়লে মাঝে মাঝে এই স্মৃতিগুলোকে বার করে সযতনে হাত বোলাবো, যেরকম করে আমরা গোপন ফোঁড়ায় হাত বোলাই। খুব যত্নে। সঙ্গোপনে। আদরের সাথে। দিয়ে ঝোলাটাকে কাঁধে ফেলে আবার আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু।
চল মুসাফির, বাঁধ গাঁঠেরিয়া.......

ইতি,
....

Comments

  1. এই ভেবে অবাক লাগে যে ইন্টারনেটের হাজারো পেজের ভীড়ে এই লেখা না পড়া হয়ে রয়েছে। তবে সত্যি বলতে কী, এই না পড়াটা সেইসব না-পাঠকদেরই লস। আর কিছু নয়।


    ঘটে তো সবকিছু সবার সাথেই। কিন্তু এই দেখার চোখ, বোঝার মন আর।লেখার হাত খুব কমজনের হয়।
    লিখতে থাক।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts