ঠিকানাহীন চিঠি : ১

প্রিয়তমা,
দেখবো-দেখছি করতে করতে পুজোটা এসে গেলো। এবারে জানো, পুজোর গন্ধটা সেইভাবে আর পেলাম না। পাওয়া হলো না। আমার কাছে পুজো এলো প্রতিদিন ট্রেনে যাওয়ার রাস্তায়, ভিড়ে ঠেসাঠেসি করতে করতে একঝলক নীল আকাশ ও আইসক্রিমসম দুগ্ধফেননিভ মেঘের খুনসুটি দেখতে পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
এইভাবে পুজো আসবে, ভাবতে পারিনি। বড়ো হয়ে গেলাম, জানো। আগে হলে পুজোর জামাকাপড়, কোনদিন কী পরবো, এই নিয়ে মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া, মাথার পাশে ক্যাপ বন্দুক নিয়ে(অবশ্যই ক্যাপ খুলে) ঘুমোনো, সকালবেলা থেকে পাড়ার প্যাণ্ডেলে বসে থাকা - এইসব নিয়ে পুজো কেটে যেতো।
জানো, আমার কোনো বন্ধু সেইভাবে কোনোদিনই নেই। পাড়াতেও ছিলো না। একা একা চুপ করে বসে থাকতাম, আর পা দোলাতাম। চারপাশে লোকে ঘুরতো, বন্ধুরা আড্ডা দিতো, ছেলেমেয়েরা প্রেম করতো, আর আমি পা দোলাতাম আর গান গাইতাম। আমার গলাটা বড্ড বেসুরো। তাতে আটকাতো না কিছুই। আপনমনে, আস্তে আস্তে গেয়ে যেতাম একের পর এক গান। শেষে চেয়ার ছেড়ে চুপটি করে উঠে ঘরে চলে যেতাম। কেউ জিজ্ঞাসাও করতো না, বিদায়সম্ভাষণও জানাতো না। আমার অবশ্য তাতে কিছু এসে যেতো না। আমি ছোটো থেকেই একলাটি বড়ো হয়েছি। বাবা-মা চাকুরিসূত্রে বাইরে থাকতো সারাদিন, আর আমি প্রাণবন্ত মৃতের স্তুপে, অর্থাৎ কিনা, বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে দিন কাটাতাম। 'My days among the Dead are past;
Around me I behold,
Where'er these casual eyes are cast,
The mighty minds of old;
My never-failing friends are they,
With whom I converse day by day.'
সাউদির এই কবিতাটা আমার দাদু, যাকে আমি ভালোবেসে 'ভল্টু' বলে ডাকি, তারই লিখিয়ে দেওয়া একটা প্যারাগ্রাফে পাওয়া ইস্তক মনে গেঁথে রেখেছিলাম।
আমার দিন কাটতো অপুদুর্গার সাথে। আমার দিন কাটতো শঙ্কুর সাথে। আমার দিন কাটতো উপেন্দ্রকিশোরের সাথে, সুকুমারের সাথে, লীলা মজুমদারের সাথে। আমার দিন কাটতো এনিড ব্লাইটন আর ষষ্ঠীপদ চাটুজ্যের সাথে। সেই দিনগুলো বড়ো ভালো ছিলো, জানো। কোনো চিন্তা ছিলো না, আশঙ্কা ছিলো না, পড়াশুনার চাপ ছিলো না, প্রেম ছিলো না, বাইরে মদ খেয়ে বাড়িতে ধরা পড়ার ভয় ছিলো না, বাবার পকেট থেকে সিগারেট চুরি করে ধরা পড়বার চিন্তা ছিলো না। বেড়ে ওঠবার যন্ত্রণা ছিলো না। 'I mourn that the days have so soon glided by...' পেটভরা খাবার, নিশ্চিন্ত ঘুম, গল্পের বই, গান, সিনেমা নিয়ে কাটতো।
যাইহোক। অন্যদিকে চলে যাচ্ছি বড়ো। এইটাই আমার দোষ, জানো, লিখতে লিখতে কী লিখি, কেন লিখি, জানি না। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই বার বার। আমি ভালো বক্তা, বা ভালো লেখক কোনোদিনই না। বড্ড আবেগপ্রবণ। আবেগ রমণ করে চেতন ভগত আসতে পারে, বাজারে কাটতে পারে। তবুও, আমার কলাকৈবল্যবাদ ছাড়া আর কিছুই যে নেই!
যাকগে। এইবার পুজোটা বড়ো অদ্ভুত লাগছে। বড়ো ক্লান্ত লাগছে। বিষণ্ণ লাগছে। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে। পিছুটানগুলো এড়াতে পারি না, এই যা।
জানো, এইরকম এক পুজোয় আমি প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম। ক্লাস এইট কি নাইন হবে। আর পাঁচটা বাঙালীর মতোই, অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে প্রেমে পড়ি।
দিনটা বার বার মনে পড়ছে আজ। বরাবরের ঘুমকাতুরে আমিকে ধাতানি দিয়ে, চাদর টেনে বাবা ঘুম থেকে তুলেছিলো। কোনোমতে ঢুলুঢুলু চোখে স্নান সেরে, নতুন পাঞ্জাবি গায়ে গলিয়ে অঞ্জলি দিতে গিয়েছিলাম। তখনই তাকে দেখেছিলাম। একটা গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পরেছিলো সে। সোনালি পাড় দেওয়া। জরির কাজ বোধহয়। ওসব শাড়িটাড়ির মতন মেয়েলি জিনিস(নব্য নারীবাদীরা আমাকে ক্ষমা করবেন) আমার দ্বারা বোঝা হয় না। বোঝা হয়নি। তার পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। পিছন থেকে ফরসা, ঘেমো পিঠটা চোখে পড়ছিলো। পিঠে দু-তিনটে বিচ্ছিন্ন চুল আটকেছিলো। পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম, তারমধ্যে আটকে থাকা চুল, তার গাঢ় সবুজ শাড়ি আমাকে ইনটক্সিকেটেড করে দিচ্ছিলো। আমি ধুলোপড়া সাপের মতন সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।
মেয়েদের সিক্সথ সেন্স বরাবরই ভালো, জানো। আগেও দেখেছি, তখনও দেখলাম। হুট করে পিছনে ফিরে তাকালো সে। আমার ঘোর কেটে গেলো। আমি সামনে তাকিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা মুখ দেখলাম। সেই মুখের বর্ণনা দেওয়ার মতন উপমা আমার জানা নেই। আমি কবি নই, সাহিত্যিক নই, আলঙ্কারিক নই। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, সেই মুখটা অন্যরকম অদ্ভুত, অন্যরকম সুন্দর।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি। আবার মুখ ঘুরিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকে, দিয়ে বেরিয়ে যায়।
আমি তার নাম,ধাম, পরিচয়, কিচ্ছু জানতে পারিনি। জানার আগ্রহ হয়নি। বা সাহস হয়নি।
চণ্ডাল দিয়ে কি দেবীপূজা হয়?
এখন জানো, পুজোতে প্রেমে পড়াটাও বড্ড মেকি হয়ে গ্যাছে। কেউ প্রেমে পড়ে না। কেউ ক্যাপ বন্দুক ফাটায় না। এইবছর ক্যাপ বন্দুক ফাটাতেও দেখলাম না সেরকম কাউকে। সবই কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গ্যাছে। নাকি, আমি নিজেই ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছি? বা অত্যন্ত নিহিলিস্ট হয়ে গেছি?
কে জানে।
পুজোটা কেমন বদলে বদলে যাচ্ছে। সাথে আমিও। সাথে ছোটোবেলাটাও। সেই আমেজটাও।
এই বদলগুলো কি দরকারি ছিলো?
বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল। কে জানে, কেন।
যাইহোক। অনেক কথা বলে ফেললাম। এইটুকুই থাক। শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জেনো।
ইতি,
....

Comments

Popular Posts