বড়ো দিন

বড়োদিন। দিনের কি আর বড়ো ছোটো আছে রে পাগল? এ দিন দীন বা বড়োলোক কোনোটাই না। কিন্তু, এই দিন-ই-ইলাহীতে এলাহী ব্যবস্থা হয়। স্বয়ং যীশুখ্রিস্টের হ্যাপিবাড্ডে বলে কথা! তার জন্মের সময়ে তিন বৃদ্ধ জ্ঞানী মানুষ উড়ে এসে ধূপচন্দন দিয়ে গেছিলো, যাদের ছোটোবেলায় মাগী বলতাম - যদিও পুরুষমানুষ কীভাবে মাগী হবে, এই ব্যাপারটা সাল্টে উঠতে পারতাম না (তখনও জেন্ডার নিয়ে ধারণা গড়ে ওঠেনি, woke বলতে ঘুম থেকেই জাগা বুঝতাম)। পরে যখন এক ইঞ্জিরিশিক্ষিত বন্ধু বুঝিয়ে দেয় যে ওটা ম্যাজাই, তখন মানবইতিহাসের এক অবোধ্য রহস্যের দ্বার চোখের সামনে উদঘাটিত হয়ে যায়। 

আমরা যারা কনভেন্টলালিত ও কলোনিপালিত নই, তাদের কাছেও বড়োদিন আর পাঁচটা দিনের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিলো। যাদের কপাল এবং বাবা-মা ভালো ছিলো, তারা সান্তাক্লজের গিফট পেতো, এবং যাদের বাবা-মা এবং কপাল ভালো ছিলো না, তারা পেতো আমাদের সমবেদনা। এই সান্তাক্লজ আমার কাছে বিশ্বের ত্রয়োদশ আশ্চর্যের মধ্যে ছিলো। কাবুলিওয়ালা আফগান রহমতের এই কমিউনিস্ট ভাইয়ের ঝোলায় হাঁথির পাশাপাশি এতো কিছু কীভাবে যে ধরতো, যেটা নিয়ে সে বিশ্বময় শিশুর চাহিদা পূরণ করতে বেরোয় 'নিয়ে ঝোলা চললো ভোলা' গাইতে গাইতে, সেটা কোনোদিন বুঝিনি। তবে আমার দৃঢ় ধারণা ছিলো, সান্তাক্লজ বাংলা বোঝেনা। একবার চেয়েছিলাম রিমোট কন্ট্রোল ট্রেন, পেয়েছিলাম পথের পাঁচালী। আরেকবার চেয়েছিলাম টিনটিনের বই, পেয়েছিলাম শঙ্কু সমগ্র। দুবারই দেখেছিলাম, বইয়ের মধ্যে খড়দহ বইমেলার বিল। ভেবেছিলাম, সান্তা নিশ্চয়ই বইমেলায় স্টলগুলো বন্ধ হওয়ার আগে হাতের সামনে যা পায়, খাবলা মেরে তুলে নেয়। খারাপই লাগতো। একা একা একটা লোক, সন্ধে থেকে বিশ্বজুড়ে বাজারহাট করতে বেরোয়, এবং এদিকসেদিক হয়ে যায়। হয়তো কোনো জন্মান্ধ শিশুকে রঙিন গগলস গিফট করেছে, বা বধির কোনো শিশুকে নতুন ইয়ারফোন দিয়েছে, এমন ঘটনাও নিশ্চয়ই ঘটে। লাল কাবুলিওয়ালার প্রতি আমার মন মিনি-সম ম্যাক্সি সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। আহারে, একটা লোক খান সাতেক বল্গা হরিণকে চাবকাতে চাবকাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ভুঁড়ি নিয়ে চিমনি বেয়ে নেমে এসে (বাঙালি ঘরে কীভাবে আসে, খোদায় মালুম) গন্ধমোজার পাশে গিফট রেখে যায় অন্ধকারে। কী খাটনি ভাই। তাকে গালাগাল দিয়ে লাভ আছে?

কিন্তু, এমনও একদিন এলো, যেদিন খোঁখা সোসুরবাড়ির মানে বুঝে গেলো, ফলে সান্টা তখন কাবুলিওয়ালা থেকে ডিমোটেড হয়ে গেলো। কিন্তু তবুও, বড়োদিনের আনন্দ কোনোদিনই তেমন মাটি হয়নি। বড়োদিন মানেই রিচুয়াল ছিলো, ভল্টু (আমার মা'র বাবা) কেক আর কমলালেবু নিয়ে সকাল সকাল এসে বেল বাজাবে। খুবই আনন্দে কাটতো সারাদিন - পড়াশুনো তো নেইই, বরং তাধিন তাধিন করে দিনটা কাটানো যাবে। বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়তাম ভল্টুর সঙ্গে, স্কুলের বন্ধুদের জন্য গ্রিটিংস কার্ড কিনতে। আট আনা থেকে একটাকার যে অত্যন্ত প্যাতপ্যাতে, দেড় বাই দুই ইঞ্চির যে কার্ডগুলো, সেগুলো থাকতো সাধারণ বন্ধুদের জন্য। ৫-১০ টাকারগুলো থাকতো বেঞ্চের সদস্যদের জন্য। আর কুড়ি কি তিরিশ টাকার যে কার্ডগুলো, বেশ বড়োসড়ো, খুললে পরে কেক গাড়ি টেডি বেড়াল কুকুর হাতি কেল্লা ইত্যাদির ত্রিমাত্রিক জেল্লা দেওয়া কার্ডগুলো ছিলো বেস্ট ফ্রেন্ড যে, তার জন্য। আবার যদি হিসেবের বাইরের কেউ কার্ড দিতো, তার জন্য আবার গিয়ে কার্ড কিনতে হতো, সে যে দামের দিয়েছে, সেই দামের অনুপাতে। সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কার্ডের দামের অর্থনীতি সেই বালক, বা না-বালক বেলাতেই দিব্য বুঝে গিয়েছিলাম।

আমাদের মফস্বলের বড়োদিন আসলে এরকমই ছিলো কমবেশি। খৃষ্টে আর কৃষ্টে তফাত আছে কি নেই, এই নিয়ে চুলোচুলিও হয়নি কোনোদিন। আবার, বিশ্বায়নের জোয়ারে ভেসে গেলেও হুজুগে মাতিনি কেউ কোনোদিন। পার্ক স্ট্রিটে না এতো ভিড় হতো (যদিও লোকজনের জীবনে তখনো পুলক ছিলো, এখনকার মতো না হলেও), না 'যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন কি পার্কস্ট্রিটে?' বলে অত্যন্ত উচ্চস্তরের হিউমার দেখানোর চল ছিলো। পার্কস্ট্রিটের ঝলমলে আলো, সাহেবিয়ানা, ক্রিসমাসের সাজ, অ্যালেন পার্কের সামনের ক্রিসমাস ট্রি - এগুলো সবই কেমন একটা অধরা স্বপ্নের মতো অপাপবিদ্ধ ছিলো, প্রত্যাশার আলোয় ভাস্বর। বড়োদিন মানে আমাদের কাছে ছিলো কাউন্টডাউন - নতুন বছর, স্কুলে ফেরত যাওয়া, আবার গল্প-খেলাধুলো, আবার পড়াশুনো শুরু - মার্চেই অ্যানুয়াল (তখন অদ্ভুত একটা সাইকেল ছিলো)। বড়োদিনের কেক ছিলো, কমলালেবু ছিলো, সান্তা ছিলো, নির্মল আনন্দ ছিলো - আর আমার কাছে আমার ভল্টু ছিলো। 

ভল্টু চলে গেছে অনেকদিন হলো। টেবিলে এখনো কেক আর কমলালেবু রাখা কালকের জলখাবারের জন্য। কিন্তু জানি না কেন, কেক আর কমলালেবু আর আগের মতো মিষ্টি লাগে না। কার্ড কিনতে হয় না - দেবো কাকে? রাতে বিছানায় শুয়ে ঘাপটি মেরে 'এই সান্তা এলো, দেখবো কেমন দেখতে' - ও করতে হয় না। সারপ্রাইজের আনন্দ অনেকদিন আগেই মুছে গেছে। মানুষের তো আর মৃত্যু হয় না, হয় ইনোসেন্সের; বাকি জীবনটা পরিপক্কতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব লড়ে যাওয়া কেবল। আসলে, জীবনটাও এই বড়োদিনের মতোই। যতো বয়েস বাড়ে, ততো তার জৌলুস কমতে থাকে। তবুও কোথাও গিয়ে হলেও আমরা অপেক্ষা করে থাকি, যদি ঝুমঝুমি বাজিয়ে এক সাদাদাড়ি বুড়ো এসে এক মুঠো আনন্দ রেখে যায় মোজার ভিতরে। আমেন।

Comments

  1. অসাধারণ, শীতের দিনে যে লেখাগুলো নরম আদরমাখা ওম ছড়ায়, এ তেমনই এক লেখা

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts