স্বপ্নাদ্য...
পৃথিবীর সকল আঁতেল কমরেড-বেশিলালরা জীবনের কোনো না কোনো এক সময়ে যে ব্যক্তিবিশেষকে পুজো (এথেইস্ট হলে অস্বীকার, অ্যাগনস্টিক হলে সন্দেহ) করে এসেছেন, তিনি হচ্ছে আমাদের সবার প্রিয়, ইডিপাস যাপন ও ইলেক্ট্রা-বাপনের প্রবক্তা, ট্যাবু-টোটেম ও লিবিডো-গেমের ফেমওয়ালা ফ্রয়েডকাকু। স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে কাকুর একটা ঝকাস্টিক বই আছে, যেটার শুরু থেকে শেষ প্রায় একই রকমের দুর্বোধ্য, অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির থারুরোচিত মিক্সটেপ গোছের - সেখানে কাকু অসম্ভব ঝিঙ্কুঝিঙ্কু স্বপ্নব্যাখ্যা, স্বপ্নথিওরি ইত্যাদি দিয়ে গেছেন। সেসব বই পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যায়, আর মাংসের হাড় চিবোনো যায় না - ফলে, পড়িনি। কিন্তু, আমার এক অদ্ভুত স্বপ্নদর্শনের কোনো ব্যাখ্যা তাতে আছে কি? বিদ্বজনে সাহায্য করলে সুবিধে হয়।
নিচে সেই স্বপ্নটা সিন বাই সিন লিখলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। আমি নিখিলেশ বা সন্দীপ না হলেও প্যারিসে। ট্রিপল এজেন্টের কাজ করছি। আমার কাছে তখন জার্মানদের তথ্যও আছে। প্যারিসে কোথায় কোথায় বোম্পুঁতবে। ব্রিটিশদেরও। ফরাসিদেরও। সবার তথ্য নিয়ে আমি বসে বসে একদিন পারির বিখ্যাত কাফে দে জেনিতে চা আর নারকেল কোরা দিয়ে মশলা মুড়ি খাচ্ছি।
হঠাৎই একটা লোক ঢুকলো ক্যাফেতে। শ্বেতাঙ্গ, দীর্ঘদেহী; প্রায় সাড়ে ছ'ফুট হাইট; স্যুটেডবুটেড। মাথায় সোনালি চুল। ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে একটা ভাও দেওয়া বাও করলো, দিয়ে সজোরে হাঁচলো। টিসু দেবো না ব্লেসিং, বুঝতে পারলাম না - যদিও, অনতিবিলম্বেই বুঝলাম, সে আসলে হাঁচেনি - বললো
-- বঁজু মঁসিয়!
আসলে ফরাসি ভাষা কিঞ্চিৎ সানুনাসিক কিনা, কথা বললেই মনে হয় সর্দি লেগেছে।
ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-- মঁসিয়, কী হয়সিঁও?
মঁসিয় হাঁচিভাই আমাকে হেঁচেকেশেগলাখাঁকারি দিয়ে ফরাসিতে যা বললো, তার মোটামুটি দাবি হচ্ছে এই, যে মাও জে দং লং মার্চ করে হাতে জিনহাওয়ের চিনে কলম আর মেড ইন চায়না ছাপ মারা প্লাস্টিকের খেলনা বন্দুক উঁচিয়ে প্যারিসে আসছে জার্মানদের মারবে। তার সানাইবাদনের গৎ বোঝার চেষ্টা করছি, আর বুকপকেটে রাখা চ্যাপ্টা সিগারেট কেসের পিছনের টেপরেকর্ডারে সব রেকর্ড করছি।
এমন সময়ে হঠাৎই এক ভারতীয়, গায়ে গেরুয়া ব্লেজার এবং মুখে একটা গোল ফ্রেমের চশমা পরা, গম্ভীর মুখের লোক দরজা ঠেলে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে হাঁচিভাই ঝুঁকে পড়ে 'মঁসিয় ঁতাজি (ন সাইলেন্ট)' বলে প্রণাম করতে যেতেই তাঁর এক থাপ্পড়।
-- চোপ শালা ইনফ্লুয়েঞ্জার পেশেন্ট, আমি গুমনামী বাবা জানিস না?
সেই শুনে ক্যাফের কাউন্টার থেকে বাংলা সিনেমার ফার্স্টবয় আর কনস্পিরেসি তত্ত্ববিদের কী হুল্লাট সিটি!
তারপর সে এক হুল্লাট ক্যালাকেলি হাঁচিভাই আর গেরুয়া ব্লেজারের মধ্যে। এসবের মধ্যে হাঁচিভাই ফরাসিতে ‘কুকুর’ বলে গালাগাল দিলো গু৷ সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে সন্তুর প্রবেশ।
— কী, কে ডাকলো আমাকে? কাকাবাবু
— আরে ভাই না, জোজোর কুকুর বলিনি। তোজোর কুকুর।
এইসব ক্যালাকেলিতে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম
বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এলাম। পেরোতেই দেখি জাঙিয়া পরে মিহির দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম।
— আরে মিহির যে! থাক থাক। কী খবর?
মিহির হাতজোড় করে বললো,
— খবর ভালো না বদ্দা। এভাবে পায়ে হেঁটে ইংলিশ চ্যানেল পার? বদ্দা, প্লিজ, এইটা কেউ যেন না জানে, আমার ভাতকাপড় মার যাবে!
খানিকটা অপ্রস্তুতই হলাম। শর্টকাট নেওয়ার জন্য এতোটা না করলেই হতো। ইংল্যান্ড তো গাড়ি ধরলেই যাওয়া যায়। আমতা আমতা করে বললাম,
— ইয়ে, না না৷ আসলে বুঝিনি তুমিও যে আছো এখানে। ভুল হয়েছে ভাই।
— সে ঠিক আছে, কিন্তু স্রেফ হেঁটে কীভাবে পার হলে বদ্দা? একটু শেখাবে? আসলে পরের বার কাস্পিয়ানটা টার্গেট করছি…
— এটা তো সিক্রেট মিহির।
মিহির কাঁচুমাচু করে বললো,
— শেখাবে না দাদা?
খারাপ লাগলো। যতই হোক, ছোটোবেলায় পিঠে জেরিক্যান(লোকে যাকে জারিকেন বলে) বেঁধে সাঁতার কাটা আমিই শিখিয়েছিলাম৷
— ঠিক আছে, বলছি। তবে এসব গুহ্য কথা, বাইরে বেশি বলো না। জলে নামার আগে পায়ের পাতায় ভালো করে সর্ষের তেল আর কেও কার্পিন ফ্রেঞ্চ অলিভ অয়েল মিশিয়ে মেখে নিলেই জলে হাঁটা যায়।
মিহির জাঙিয়ার পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে টুকে নিলো।
— ধন্যবাদ, বদ্দা। দেখা হবে!
মিহিরকে টাটা করে হাঁটতে হাঁটতে উঠলাম গিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে। ১০ ডাউনিং স্ট্রিট। বেল বাজাতেই উপর থেকে ভারি গলা,
— অর্চিদা, দরজা খোলা আছে, উপরে চলে আসো।
তিনতলা খাড়া সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম উপরে। একনম্বরের হাড়চিপ্পুস মালটা৷ একটা লিফটও বসায়নি।
তিনতলায় উঠে বাঁদিকের মেহগনি কাঠের দরজা ঠেলে দেখি, চার্চু প্রায় নগ্নাবস্থায় বসে এক ধামা চালভাজা চিবোচ্ছে। আমাকে দেখে ধামা বাড়িয়ে দিলো।
— নাও, খাবে? ফার্স্টক্লাস চালভাজা, শুকনো খোলায় ভাজা।
ঘৃণাভ'রে প্রত্যাখ্যান করলাম।
— না হে চার্চু। এ তো আমাদের দেশ থেকেই ঝাড়া চাল খাচ্ছো। এ খাই কী করে বলো? দেশে, মানে আমার প্রভিন্সে লোক মরছে, সিপিআই ফুটেজ কুড়োচ্ছে, কংগ্রেস বিশ্বযুদ্ধে যাবে না স্বাধীনতা ভিক্ষা করবে বুঝতে পারছে না, আমি এই চালভাজা কেমন করে খাই? লোকে মরছে চার্চু!
চার্চু হাতের গালটা শেষ করে বললো,
— আরে তুমিও যেমন! ওই তোমাদের নেকেড ফকিরও তোমাদের বোঝায়, তোমরাও নাচো। আর কমিউনিস্টদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ভেবেছিলাম মীরাটে সাল্টে দিয়েছি, শালারা যে কুকুরের ল্যাজ, কেমন করে বুঝবো? এই যে জিওটি…
— জর্জ আর আর মার্টিনের, না এইচবিও?
— আরে ধুত, সে জিওটি, মানে গেম অফ থ্রোন্স না। জিওটি বাসু। তবে ফ্যান্টাসিই, কিন্তু উচ্চগ্রামের।
— অ। তা সে কী করলে?
চার্চিল আরেক গাল চালভাজা মুখে পুরে তারিয়ে তারিয়ে চিবোতে লাগলো। ভরা মুখেই বললো,
— আরে, এখানে আমাকে দেখলেই একদল ডার্টি নিগার এসে 'চালচোর চালচোর' বলে ডাকে। সব শালা জিওটির চক্রান্ত। দেখবে, একদিন ও কালেদিনে তোমাদের দেশের কড়িবরগা কাঁপিয়ে দেবে।
ধামাটা নিচে নামিয়ে রাখলো চার্চিল। একটা চুরোট ধরালো, আমার দিকে একটা বাড়িয়ে দিলো। নিলাম। উৎকৃষ্ট হাভানা সিগার৷ আমার চুরোটে আগুন ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আর শোনো হে, তোমরা যে বলছো লোকে মরছে, কেন মরছে সেই খবর রাখো? চাল আমি নিয়েছি শুধু? ওই শালা বেঁড়ে blurred জাপানির জাত, বর্মাতে এসে করিতকর্মা হয়ে গেলো। ওখান থেকে চাল আর আসছে না। আমরা কী খাবো, ঘেঁচু? আর আমরা না বাঁচলে, তোমরা বাঁচবে? এই যে তোমরা অ্যাসেম্বলি অ্যাসেম্বলি করে ক্ষেপে উঠেছো, এখন যদি ওই পেরজাপতি গোঁফের আর্টস্কুল ড্রপাউটের বাচ্চা হাল্কাকরে একটা হাইড্রোজেন নামায়, কে বাঁচাবে? আমরাই তো? কিপলিং পড়োনি?
—হ্যাঁ, জাঙ্গল বুক, মোগলি..
— ধুর, ও শালা আগলি। চিতাবাঘের ছাল দিয়ে জাঙিয়া পরে নিজেকে টারজান ভাবে। ওসব ফালতু লেখা নয়। হোয়াইট ম্যান'স বার্ডেন পড়োনি? ওই যে, আমরা তোমাদের নিগারদের ফিগারবোঝা মাথায় নিয়ে বৈতরণি পার করছি৷ তোমরা চাল বা চুলো, নিয়ে করবেই বা কী? তারমধ্যে আদ্ধেক চাল তো নানা রোগেই শেষ হয়ে গেছে। ইফ দ্য নিগার্স কান্ট হ্যাভ ডালভাত, লেট দেম হ্যাভ বিরিয়ানি।
আমি ব্যোমকে গেলাম। চুরোটের ধোঁয়া ছেড়ে বললাম,
— যাহ শালা, এতো মারি আঁতোয়েত আর বুম্বাদার ককটেল। বাবা চার্চু, সানডাউনের আগেই আবার স্কচ মেরেছো? এসব পেঁয়াজি মারো তুমি, দেখবে এটলি তোমার কেটলি তুলে বাইরে ফেলে দিয়েছে একদিন।
চার্চু চুপ করে গেলো। গম্ভীর হয়ে চুরোট টানতে লাগলো। বেশিই আঘাত দিয়েছি হয়তো। খানিকক্ষণ গম্ভীর থেকে জিজ্ঞেস করলো,
— বলো, কী দরকার।
— দরকার কিছুই না। ফ্র্যাঙ্কির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে?
— তা চলছে। কিন্তু কিছুই বুঝছি না। তোমার কাছে লেটেস্ট খবর আছে কিছু?
— খবর তো আছেই। জার্মান নাৎসিদের গাইগার কাউন্টার নিয়ে অ্যাঙ্গোলার ওদিকে ঘুরতে দেখা গেছে, জানো?
— তো?
— তুমি একটা গবেট৷ তোমার থেকে বার্কেনহেডের মাথায় বেশি বুদ্ধি ছিলো।
— আরে ধ্যাত, গালাগাল না করে বলো তো৷ নাৎসিরা অ্যাঙ্গোলা কলোনাইজ করছে নাকি? ওখানে তো পোর্তুগিজরা গিজগিজ করছে। আমরা কী করবো?
— ওহে ইডিয়ট, ওদিকটায় কী লেভেলের পিচব্লেন্ড ডিপোজিট রয়েছে, সেই আইডিয়া পেলে হয়েই যেতো। পিচব্লেন্ড থেকে কী পাওয়া যায়, আর তা যে কী কাজে লাগে, সেটাও কি জানো না মূর্খ?
চার্চিলের মুখ শুকিয়ে গেলো। একরাশ ধোঁয়া গিলে বিষম খেতে লাগলো। মুখেচোখে জল দিয়ে ধাতস্থ করলাম ওকে। হাঁপ টানতে টানতে বললো,
— তবে, ওরাও কি অ্যাটম…
— যাক, অতটাও মর্কট হওনি। আজ্ঞে, হ্যাঁ। ফ্র্যাঙ্কিকে একটু তাড়াতাড়ি এগোতে বলো ম্যানহাটনের কাজটা৷ ওপির খবর কী?
দরজা নক করে টুপি পরা সিলিয়ান মার্ফির প্রবেশ।
— তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে, কেউ তা জানে না, আমার মন যে কাঁদে আপন মনে, কেউ তা মানে না… নমস্তে! আই হ্যাভ বিকাম ডেথ…
একটা সেন্সরড মার্কিন গালাগাল ঝেড়ে ওকে বললাম,
— এই শালা টমাস শেলবি, তোর অওকাত টুপির ভাঁজে ব্লেড রাখা, আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাতেলা ঝাড়া অবধি। তোকে কে ডেকেছে বে? আই হ্যাভ বিকাম ডেথ? সোজা আইসিবিএমের মাথায় বসিয়ে বিকিনি অ্যাটল থেকে ছাড়বো, লেংটি পটলে গিয়ে পড়বি। ভাগ!
গালাগাল খেয়ে মার্ফি দুদ্দাড় দৌড় দিলো। চার্চিল কৌতূহলী স্তরে জিজ্ঞেস করলো,
— কে ও?
— ও আছে। ওটিটি দেখো না, না?
— সে তো তুমি আমার ওটিটি। তোমাদের এনশিয়েন্ট স্ক্রিপচারসেই তো আছে, ওটিটি ডেবো ভবো।
মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। এর সঙ্গে খানিকক্ষণ থাকলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। রোষকষায়িত দৃষ্টি হেনে বললাম,
— এসব ছ্যাবলামি না মেরে, শিগ্গির ফ্র্যাঙ্কির সঙ্গে কথা বলো। আইজুকেও জানাও। ওদের বলো, ব্যবস্থা করতে। আমি উঠছি এখন। জর্জদাকে বলো, পরেরবার দেখা করে যাবো।
— ডেবোব্রোটো স্যার এখানে নাকি? কোথায়? কোথায়?
চার্চিলের মুখ ঝলমল করতে লাগলো। দেওয়ালজোড়া বড়ো কাঁচের শারশির ফাঁক দিয়ে রাস্তায় ইতিউতি খুঁজতে লাগলো।
একটা অস্ফুট গালাগাল দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামলাম। গন্তব্য হিথরো। জেট দাঁড়িয়ে ওখানে।
জেটে উঠলাম। সোজা ন্যুরেমবুর্গে নামবো। ওখান থেকে গাড়ি ধরে বাভারিয়া, বের্খতেশগাবেন। হিটুর হেডকোয়ার্টার, বের্গহফ। ভারি সুন্দর জায়গা। হিটুর সত্যিই শিল্পী হওয়া উচিত ছিলো। কপালের ফেরে.. যাগ্গে।
হিটুর বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর। আমাকে দেখেই ইভা অ্যাপ্রনে হাত মুছতে মুছতে বিগলিত হাসি হেসে বেরিয়ে এলো।
— অর্চিদা, মাইন ব্রুডার, এসো এসো।
পায়ে হাত দিয়ে গলঅ্যাপ্রন হয়ে পেন্নাম ঠুকলো একটা।
— থাক থাক মা। স্বামী নিয়ে সুখে বাঙ্কার করো। হিটু কই? বাজারে?
ইভা মুখ কুঁচকে বললো,
— আর বলবেন না। এই আপনার ভাইকে নিয়ে পেরেই উঠি না। বার বার বলেছিলাম, আপনি আসবেন, যেন সক্কাল সক্কাল বাজার থেকে একটু ভালো দেখে ড্যানিউবের ইলিশ নিয়ে আসে, চাড্ডি কুমড়ো আর ঝিঙেও যেন আনে। ইলিশের গরমাগরম ভাপা করবো, আর কুমড়ো-ঝিঙের ঝোল, আর ভাজা। কয়লাও শেষ - গবাকে পাঠালাম একটু রুর ছাপ কয়লা আনতে। এখানে রুর ছাপ কয়লার যা দাম, ১৫০০০ মার্ক নিচ্ছে বড়ো এক বস্তা, ভাবা যায়! তা আপনার ভাই সকাল থেকে গবা, গোঙু আর হিমুর সঙ্গে তাস পিটিয়েই কাটালো। শেষে চেঁচামেচি করতে একটু আগে বেরিয়েছে। আপনি আসুন দাদা ভেতরে।
ইভা গজগজ করতে করতে ঢুকলো, পেছন পেছন আমি। ভারি সুন্দর করে গোছানো সব। হিটুটার জন্য ভালোও লাগে। প্রথম জীবনে জেল খেটে, কেরিয়ারে ব্রেক না পেয়ে, পছন্দের মানুষকে জীবনে না পেয়েও হাল ছাড়েনি। এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে শুধু না, বাকিদের মাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে। ইভাও সুযোগ্যা পত্নী। ধন্য বীর হিটলার, যে হিটের পাশে/প্রেমপাশে বাঁধা সদা হেন সৌদামিনী। একা হাতে সংসার থেকে ক্যাম্প, সব কনসেনট্রেশান দিয়ে সামলাচ্ছে দশভুজার মতো, নিজেকে উজাড় করে।
সদ্য বসে গরমাগরম বাভারিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, বাইরে থেকে ভ্যাঁপ ভ্যাঁপ করে ডেমলার-ক্রাইসলারের আওয়াজ। অতিপরিচিত হর্ন। ছাইরঙা জামাপরে হিটু ঢুকলো। হাতে বাজারের থলে।
আমাকে দেখেই একগাল হাসি।
— আরে, কমরেড, কী ব্যাপার?
— এই চলছে কমরেড। হাইল ফ্যুয়েরার বলতে হবে আমাকেও? নাকি না বললে গ্যাসচেম্বারে ফেলবে?
জিভটিভ কেটে হিটু বললো,
— এবাবা, তুমি কি সিলভিয়া প্লাথ নাকি হতচ্ছাড়া জু? বালাই ষাট। তুমি আমার দাদা হও। এসব পেছনে লেগো না তাবলে!
হাতের ব্যাগটা নামিয়ে হিটু চিক্কুড় পাড়লো,
— গিন্নি, মাইনে লিয়েবে, এই দেখো বাজার এনেছি। ড্যানিউবের ইলিশের পাশাপাশি রাইনের কইমাছও পেয়েছি। একটু জমিয়ে তেলকই করো তো! কতদিন বাদে অর্চিদা এলো!
ইভা এসে ব্যাগ ঘেঁটে দেখে হিটুর দিকে কটমট করে তাকালো।
— হ্যাঁগা, তোমার কি কোনোকালেই কাণ্ডজ্ঞান হবে না? এতো করে বললাম সর্ষে পাউডার আনতে, ভাপা করবো কি আমার মুণ্ডু দিয়ে, নাকি আউষউইৎজের ছাই দিয়ে?
হিটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো,
— এস টুট মিয়া লাইড লিয়েবলিং (দুঃখিত প্রাণেশ্বরী), জানোই তো, এই বাজারহাটের ব্যাপারটা আমার দ্বারা হয় না। আমি শুধু কার্পেট বম্বিং করে বাজার ওড়াতেই পারি। আর মাস্টার্ড চাইলে আন্ডারগ্রাউন্ডে একবার দেখতে পারো, ফার্স্ট ওয়ারের কিছু ক্যান থেকে গেছে মনে হয়।
— থাক! আর ম্যানেজ দিতে হবে না। হ্যাঁগা, মাস্টার্ড গ্যাস আর মাস্টার্ড পাউডার এক হলো? জার্মান জু আর আলিপুর জু এক? মাস্টার্ড গ্যাস দিয়ে রান্না করলে ইলিশ ভাপার বদলে দাদাকে মাটি চাপা দিতে হবে, জানো?
আমি গলাখাঁকারি দিয়ে বললাম
— আমি হিন্দু, পোড়ালে ভালো।
ইভা জিভ কেটে বললো,
— ছি ছি দাদা, এসব কী কথা! গেরস্তের অকল্যেণ হবে তো। ষাট ষাট। মাতা মেরির কৃপায় আমার দাদা শতায়ু হোক। আমি যাই, আপাতত ভাজা আর ঝোলই করি। এই লোকটাকে নিয়ে আর পেরে উঠি না। মিনসে মরলে হাড় জুড়োয় আমার!
হিটু চটে গেলো। বড্ড রগচটা এমনিতেও।
— হ্যাঁ, আমি মরলেই তো তোমার সুবিধে, না! কোনদিন নিজের ওয়ালথার পি-৩৮টা দিয়ে নিজের রগে ঠুকে মরে থাকবো, তার আগে তোমাকে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাইয়ে দিয়ে যাবো।
বিচ্ছিরি গৃহযুদ্ধ বেধে গেলো। মহা বিপদ। এইজন্য ঘরোয়া কোঁদলের মধ্যে আসতে চাই না।
খাবার টেবিলে সবাই গম্ভীর। আমি আপনমনে কই মাছের মুড়ো চিবোচ্ছি। ইভা অনেককিছু রেঁধেছে। পালংচচ্চড়ি, ড্যানিউবের ইলিশ ভাজা আর কুমড়ো-বেগুন-ঝিঙে দিয়ে ঝোল, রাইনের তেলকই, আর জার্মান ছানার কেক বিয়েনেনস্টিখ্। তবে ইভা একা রান্না করেনি, কানুও সঙ্গে ছিলো (কান্নেনবার্গ, হিটুর ভারি পেয়ারের শেফ)। হিটু এমনিতে মাছমাংস খায়ই না, কিন্তু আমার অনারে কাঁটা বেছে ইলিশ পর্যন্ত খেয়ে নিলো।
খেয়ে উঠে দুজনে দুটো জার্মান মিঠাপাতার পান চিবুতে চিবুতে বাইরের ঘরে এসে বসলাম। পকেট থেকে চার্চুর চুরোটটা বার করলাম। হিটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।
— চার্চিলের সিগার না?
— হ্যাঁ। কেন বলো তো? অসুবিধে আছে? আমি কার সঙ্গে মিশবো, কার চুরুট টানবো, সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেবো? ম্যানহাটানের খবর, হাইজেনবার্গ যে তোমাদের ঘোরাচ্ছে সেই খবর, বিহে নদীর ধারে পিচব্লেন্ডের খবর, পারীতে কোথায় কখন সেনা মোতায়েন থাকবে সেই খবর তোমাকে কে এনে দেয় শুনি?
হিটু চুপ করে গেলো।
— তবুও, তুমি চাইলে তোমাকে উৎকৃষ্ট প্রাশান চুরুট খাওয়াতাম।
— থাক। ওসব নোকুতো পরে হবে। এখন কাজের কথায় আসি। ওদিকে ম্যানহাটান কিন্তু ফাটান-ফাটান করছে, সে খেয়াল রাখো? এইজন্য বলেছিলাম, বেশি আর্য-আর্য করো না। তোমাদের বাপ বিসমার্ক কী ডেঞ্জারাস ডিপ্লোম্যাটিক ছিলেন, আর তুমি একটা গোঁয়ার। নেশাভাং করে যাও, আর গোয়াঁর্তুমি করো। প্রথমত তোমার এই হলোকস্ট শোনা থেকেই আমার হলো কষ্ট - কিন্তু কী আর বলবো। তুমি ফ্যুয়েরার, আমি আর কে। তবে ইহুদীদের না পেঁদিয়ে, ওদের সঙ্গে চুক্তি করলে অনেক কাজে দিতো। তোমার এই জেদই তোমার পতন ডেকে আনবে। কথা শুনলে ভালো, না শুনলে আরো ভালো। আমার বোনটিকেই সারাজীবন সাদা থান, থুড়ি কালো গাউন পরে ঘুরতে হবে, শাঁখা-সিঁদুর, থুড়ি ওয়েডিং রিং খুইয়ে।
এতোটা বলে হাঁপিয়ে উঠলাম।
হিটু চুপ করে শুনছিলো।
— কী বলো তো দাদা, আমরাই সহী আর্য। অখণ্ড যে জার্মানি, তাতে শুধু খাঁটি প্রাশানদেরই অধিকার।
— দেখো ভাই হিটু, তোমার মাইন কাম্ফের প্রোপাগান্ডা, তোমার লেবেনশরাউমের হ্যাজ অন্যত্র দাও। তোমার সঙ্গে কাজের কথা বলতে এসেছি, বলে চলে যাবো।
— বলো।
— সেই যে সুভাষবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা হলো…
— হ্যাঁ হ্যাঁ, হের বোস তো সেই এলেন। উবান করে তোজোভাইয়ের কাছে পাঠিয়েও দিলাম উজান বইয়ে। পৌঁছোননি উনি?
— না না, সে পৌঁছেছেন। কিন্তু তুমি ভাই একটু দেখো। চার্চিল হতচ্ছাড়াটার পেঁয়াজি আর পোষায় না। আমাদের ওখানে আবার ক্রিপসকে পাঠিয়েছিলো নেগোশিয়েট করতে। ডোমিনিয়নই দিতে চাইছে না আমাদের, দিলেও গাদাগুচ্ছের কন্ডিশন। ওদিকে লিগ আর কংগ্রেস চুলোচুলি করছে, সিপিআই দুজনের কারোর পক্ষে না থেকে সুবিধাবাদী পক্ষে যাচ্ছে, সিএসপি মাথা চুলকোচ্ছে… স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচতে চায় হিটু, কে বাঁচতে চায়? তুমি কি বোঝো না পরধীনতার এই কষ্ট? তোমার মাতৃ.. সরি, পিতৃভূমি, ডাইন ফাটারলান্ড, যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু… মনে পড়ে না হিটু, সেই ঘৃণ্য ভার্সেই, সেই ভার বয়ে চলেছো তুমি.. দুর্বল ভাইমার, যারা ভাই বোন সবাইকেই মার মার কাট কাট করার জায়গায় রেখেছে… তুমি বুঝবে না হিটু?
হিটুর চোখ ছলছল করতে লাগলো। যাক, ঠিক জায়গায় খোঁচাটা দিয়েছি। জিঙ্গোইস্টিক হ্যাজ নামালেই ব্যাটা সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে একেবারে।
— আমি দেখছি অর্চিদা। আমি সত্যিই দেখছি। বোমাটা বানাক আমার হতচ্ছাড়া ফাউল ভিজেনশাফটলাররা, একটা তাক করে ফেলবো তোমাদের বাবা ইংল্যান্ডে, একদম ওয়েস্টমিনস্টারের মাথা বরাবর, আরেকটা তোমাদের দিল্লিতে। ওয়াভেলটা বড্ড পোঁয়াপাকা। যাইহোক, জানিয়ে দেবো। তুমি ব্যবস্থা নিয়ে ইভ্যাকুয়েট করিয়ে দিও একটু।
— কবে রাম লঙ্কায়.. থুড়ি, কবে জিগফ্রিড ওয়ার্মসে আসবে, কবে ক্রিয়েমহিল্ডের সঙ্গে তার বিয়ে হবে!
— অ্যাঁ? এর মধ্যে নিবেলুঙ্গেনলিড এলো কেন?
— তোমার বোম তোমার ইয়েতে গোঁজো। ওসব না করে কিছু প্যাঞ্জার পাঠাও। সুভাষবাবু নেফার দিক দিয়ে ঢুকবেন ভারতে। একটু প্যাঞ্জার হলে ভালো।
হিটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো,
— এখন তো মোটে একটাই প্যাঞ্জার এখানে, সেটা নিয়ে তোমার বোন মার্কেটিং-এ যায়। ওটা দিলে..
— আহা, এক্ষুণি কে চেয়েছে? তুমি সময়সুযোগ করে পাঠিও। আমি মাঝে এসে তাগাদা দিয়ে যাবো। উঠি আজ। ইভা বোধহয় ঘুমোচ্ছে, ওকে আর ডাকতে হবে না। অনেক খাটনি গেছে বোনটার।
বেরোনোর সময়ে হিটুর পেটে একটা খোঁচা মেরে বললাম,
— এই যে, বৌয়ের মুখঝামটায় অতো মুষড়ে পড়ো না। ঝগড়া হলে প্রেম গাঢ় হয়। একটু গীতগোবিন্দ পড়ো। ম্যাক্সদা অনুবাদ করে গেছে তো। রাতের বেলা বৌকে একটু চুপিচুপি গিয়ে ‘রতিসুখসারে গতমাভিসারে’ ইত্যাদি শুনিয়ে এসো। চললুম হে ভায়া। বেশি ইহুদী মেরো না। লেবেন উন্ড লেবেন লাসেন (নিজেও বাঁচো, অন্যদেরও বাঁচতে দাও)।
বেরিয়ে এসে জেটে উঠলাম। হিটুর জন্য কষ্ট হয়। রোগে রোগে জর্জরিত ছেলেটা। ওর কাজকর্মকে সমর্থন করতে পারি না কোনোদিনই, কিন্তু ওরকম গুণী ছেলে খুব কমই হয়। ইভাটাও ভারি মিষ্টি মেয়ে। মাইন গৎ, ওদের যেন ভালো হয়, দেখো…
জেট এসে পৌঁছোলো ভারতে। একটু তিহার ঘুরে আসতে হবে। জওহরটা রয়েছে ওখানে। অনেকদিন দেখা হয় না।
তিহারে পৌঁছে জওহরের সেলের দিকে গেলাম। রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা। গারদের দিকে পিঠ করে বসে কী যেন লিখছে।
— কী, জওহর, সব ঠিকঠাক?
কোটরে ঢোকা চোখগুলো আমাকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
— আরে অর্চিদা, তুমি? কখন এলে?
এগিয়ে এলো আমার দিকে।
— এই চলছে। তুমি কেমন?
— এই, দিনগত পাপক্ষয়। লেখাপড়া করে মনটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি।
— বুঝি। দেখা করে গেলাম। চার্চু আর হিটুর ওখান থেকে ঘুরে এলাম। দুজনকেই দুদিক থেকে উস্কে রেখেছি। স্বাধীনতা দূরাগত নয়।
জওহর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
— আর স্বাধীনতা। মানুষ মরছে অর্চিদা। কতো, কতো মানুষ মরছে, আর আমি জেলের মধ্যে প্রিভিলেজড হয়ে বসে আছি। ওদিকে জিন্না মনে হয় না নতুন নেশন না পেলে মানবে। রহমত বেটা ধুয়ো তুলেই রেখেছে, আর হতচ্ছাড়া ব্রিটিশগুলো তালে তাল দিচ্ছে। ক্রিপসকে ঠেকিয়েছি ঠিকই, কিন্তু কতোবার ঠেকাবো? রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে চারিদিকে সবাই। এই দাঙ্গাই কি আমরা চেয়েছিলাম, অর্চিদা?
— কী বলবো বলো। মতিদা যদি ওই সময়ে অতোটা ইগো না রেখে চলতো.. তুমিও তো বোঝো। সবার নিজের জেদ বড্ড।
— জানি। বাবা বড্ড একগুঁয়ে, কারো কথা বোঝে না। জানো, ছোটোবেলায় বাবার দুটো ভালো কলম ছিলো, সোয়ানের। একটা আমি নিয়েছিলুম - বাবার দুটো কলম, একটা নিলে ক্ষতি কী? বাবা জানতে পেরে কী মার মেরেছিলো! সেই থেকে আমার বাবার উপর অসন্তোষ। নিজের ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। কিন্তু এখন সেসব অরণ্যে রোদন করে তো লাভ নেই!
— ঠিকই। যাইহোক। সাবধানে থাকো। আসবো আবার আমি। আজ চলি। ক্লান্ত লাগছে। সেই পারি থেকে লণ্ডন, সেখান থেকে বাভারিয়া, সেখান থেকে এই বিহার…
— নানা। আসো আজ। সাবধানে থেকো। বন্দেমাতরম।
— বন্দেমাতরম!
বেরিয়ে এলাম। ঘরে ফেরা এবার। কাল সকালে একবার ওয়াশিংটন ডিসি যেতে হবে। ওদের যে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বলে ছোঁড়াটা, ও ডেকেছে। ক্লোজড ডোর মিটিং আছে একটা কী। ফ্র্যাঙ্কিও থাকবে, আইজেনহাওয়ারও। সেখান থেকে পালাৎজো ব্রাসসিতে যেতে হবে একবার, বেনু ডেকেছে। কবে যে এই ঘোরাঘুরি শেষ হবে… ক্লান্ত লাগে।
হঠাৎ অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখি, ভোর তখন ৫টা।
Comments
Post a Comment