উৎসবে-ব্যসনে চৈব....

 আগেরদিন অনলাইনে একটা আর্টিকল পড়ছিলাম, যার মুখ্য বিষয় হলো কীভাবে উৎসবের হরষের গভীরে লুকিয়ে থাকে গোষ্ঠীক অবসাদ। অবসাদের মাত্রা যত গভীর হয়, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আড়ম্বর, ভিড়, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। বিশেষত, কোভিডের প্রকোপের ফলে যে প্রজন্মগত ট্রমা সামাজিকভাবে আমাদের পঙ্গু করে দিয়েছে, তারই বশে কোভিড-পরবর্তী পুজোগুলোর ধুমধাড়াক্কা আরো বেশি। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, বোধন শব্দের মধ্যেই বোধ লুকিয়ে থাকে - এবং দেবীর বোধনের আগেই কলকাতায় লক্ষাধিক জনসমাগম সেই বোধের অভাবেরই পরিচায়ক। আমি নিজেও সেই মতাদর্শেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যে বাঙালি এবং ভারতীয় মাত্রেই হুজুগে বিশ্বাসী। কিন্তু, তবুও, কোথাও গিয়ে যেন একটু হলেও মনে হয় যে, এই উৎসবের হুজুগগুলো, বিশেষ করে এই পরিস্থিতিতে খুব একটা নিরর্থক নয়। 



মানুষ আসলে একা থাকতে ভালোবাসে না। এই একাকীত্বটা শুধুমাত্র যে দশটা মানুষের সঙ্গে গলাজড়াজড়ি করে বসে থাকা, তা নয় - এই একাকীত্বটা belongingness-এরও। এই কারণেই দেখা যায়, কোনো পপুলার টিভি সিরিজ, কোনো সিনেমা, কোনো বই (যদিও বই নিয়ে মাতামাতিটা ডাইনোসরের সঙ্গেই উল্কার বাড়ি খেয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেছে) বা যেকোনো নতুন অভিজ্ঞতার একটা সামাজিক চাপ কাজ করে, যেটাকে peer pressure-ও বলা হয়। ফলে দেখা যায়, মার্ভেল দিয়ে গুলি করে না মার্ভেলাস মারামারি করে, এইটুকুও না জানা মানুষটা মার্ভেলের নতুন সিনেমা দেখতে চলে যায়, ফ্যান্টাসি বলতে পাশের বাড়ির বৌদির বেশি ভাবতে না পারা লোক গেম অফ থ্রোনস দেখে নিচ্ছে, ডিজনিল্যান্ডকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ ভাবা লোকজন শ্রীভূমিতে ভূমিহীনের ন্যায় জড়ো হয়েছে। এমন না, যে এগুলো না দেখলে-না করলে লোকে জাতে উঠতে পারবে না। বরং, এগুলো না করলে সে বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে পড়বে। এই আলাদা হয়ে পড়া, এই একাকীত্ব, এই একলা হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ মানুষকে বোধশূন্য করে তোলে, তাকে হুজুগে মাতিয়ে তোলে।


অনেকেই মনে করেন, যাদের ব্যক্তিত্বের অভাব, যাদের নিজস্বতার অভাব, তারাই এই পিয়ার প্রেশারের চাপে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলে, হয়ে যায় ট্রেন্ডসর্বস্ব, ভেড়ার ন্যায় herd mentality-ময়। কিছুটা হয়তো তা সত্যিই। কিন্তু, 'আমি ট্রেন্ডের সামনে মাথা নিচু করবো না' এই মর্মে অনেকেই হয়ে গেছে চূড়ান্ত একা। বাকিদের থেকে আমি আলাদা, স্রোতের বিপরীতে আমাকে যেতেই হবে - এই জেদ করে স্রোত থেকেই চ্যুত হয়ে গেছে কতশত মানুষ। অথচ, একটু যদি 'আমিত্ব'কে দূরে সরিয়ে রেখে তার কালেক্টিভ সত্তাকে প্রশ্র‍য় দিতো, তাহলে হয়তো এতোটাও খারাপ সময় আসতো না। ক্ষুদ্র আমিগুলোকে কখনো কখনো বৃহৎ আমিগুলোর সঙ্গে, সামাজিক আমিগুলোর সঙ্গে, গোষ্ঠীক আমিগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হয় - নিজের স্বাতন্ত্র‍্যের স্বার্থেই - কেন না, মনে রাখতে হবে, মানুষ আসলে একা থাকতে পারে না, এবং চায়ও না, তা কাম্যও নয়।



এখন আবার উৎসবের মরশুম। অদ্ভুত কিছু মনখারাপ গ্রাস করে থাকে আমাদের যাপন। কেউ কেউ সেটা ভুলতে বেরিয়ে পড়ে ভিড়ের মধ্যে, যদি ধাক্কাধাক্কির চোটে সেসবকে দূর করে দেওয়া যায় - আর অল্প কিছু মানুষ থাকে, যারা নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ, একাকী - এই সমস্ত শহরের সবকটা ভিড় একসঙ্গে মিলেও তাদের মনখারাপের মলম হয়ে উঠতে পারে না৷ অদ্ভুত এক বোধ খেলা করে চলে তাদের মধ্যে। এই পুজো, উৎসব তাদের জন্য নয়। তারা শুধু এই আলোকোজ্জ্বল শহরের ছায়া-উপচ্ছায়ার কোণে বসে নিজেদের মনখারাপের বিনিসুতো গেঁথে চলে, আবার দিনদশেক পরের ধূসর বিষণ্ণতার শরিক হওয়ার জন্য। আসলে, উৎসব বড়ো নিষ্ঠুর। উৎসব মানুষকে যেমন কাছে আনে, তেমনই তাদের মধ্যেকার ফাঁকগুলোও বড্ড নির্মমভাবে হাইলাইট করে দেয় - বুকের মধ্যে শূন্যতা খাঁ খাঁ করে, যে অতলস্পর্শী হওয়ার মতো ডুবুরি হওয়া আর কারোর হয়ে ওঠে না।

Comments

  1. বছর কয়েক আগে বিজয়া দশমীতে একটা লেখা লিখেছিলাম। ব্লগে বা কোথাও সেটা নেই কারণ পান্ডুলিপিটাই হারিয়ে গিয়েছিল। ফলে লেখাটা কপি করা হয়নি। আজ এই লেখা পড়ে নিজের সেই উপলব্ধিটার কাছেই ফেরার একটা পথ যেন খুঁজে পেলাম। সমমনা না হলে যে বন্ধু হয় না, এই অমোঘ সূত্রের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ পেলাম আজ আবারও। কলমটাকে থামতে দিস না। অনেক বোবা আবেগের তোর কলমের এই বাকশক্তিটার দরকার।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts