ভাষাদিবস এবং...
আজকে ভাষা দিবস। মনে থাক ছাই না থাক, সকাল থেকে রাত বারোটা অবধি গান চালিয়ে কানের মাথা খেয়ে আমাদেরকেই প্রায় রফিক-বরকতদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জোগাড়। ওনারা এসব কেলোর কীর্তি হবে জানলে প্রাণ কেন, কানও দিতেন না বাংলা ভাষার জন্য। আর বাঙালি যে নিজের ভাষাকে এত ভালোবাসে, জানা ছিল না। সকাল থেকে বাংলা আমার মাতৃভাষা, ইংরেজি বাজে ভাষা, হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয় মর্মে যাচ্ছেতাই হ্যাজ চলছে। যারা দুটো বানান গুছিয়ে লিখতে পারে না, যাদের ভাষাজ্ঞান ভাসা ভাসা, তাদের ভাষার প্রতি পিরিত দেখলে হাসি কান্না সবই পায়।
দ্যাখো ভাই, কিছু লোক নিজের ভাষাকে ভালোবেসে, নিজেদের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, খুবই প্রশংসনীয় ব্যাপার, গর্বিত হওয়ার মতো, মনে রাখার মতো। কিন্তু অধিকাংশ হুজুগেই সেটা নিয়ে যা করে চলেছে, মাইরি! ভাষাসাহিত্যের ছাত্র হয়েও এতকিছু জানতে পারিনি, আজ যা জেনে গেলাম। যাইহোক, সেসব বাদ দিই। একটু নিজের জ্ঞান/ভাবনা কপচাই।
মাতৃভাষা, দেশের মতোই, খুব সংকীর্ণ একটা ধারণা, এবং ফ্লোটিং একটা ধারণা, অর্থাৎ যা দেশকালপাত্র হিসেবে বদলায়। আজকে তুমি এখানে না জন্মে মঙ্গলগ্রহে জন্মালে তুমি অ-এ অজগর না বলে তিন্তিড়ি তিন্তিড়ি বলতে, ওটাই তোমার মাতৃভাষা হত। এবার ব্যাপার হল, যারা জন্মসূত্রে দোভাষী/তেভাষী, তাদের? ধরা যাক, পুঁজিবাদী আম্রিগার এক দম্পতি, যার মধ্যে একজন ওখানকারই নেটিভ এবং ইস্পাহানি(স্প্যানিশ আরকী) বলে থাকেন, আরেকজন ধরা যাক জাতে চাইনিজ, তিনি অবশ্যই নাক কুঁচকে (ঘেন্না থেকে নয়) কথা বলে থাকেন। এবার, তাঁরা নিজেদের মধ্যে ইঞ্জিরি বলেন। তাঁদের সন্তানের মাতৃভাষা কোনটি? লিঙ্গুইস্টিক্সে এইজন্য মাতৃভাষা শব্দটা সেভাবে ব্যবহার হয়ই না, নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ, এবং আরো স্পেসিফিকভাবে, ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ বা L1 শব্দটি ব্যবহৃত হয় - অর্থাৎ, একটি শিশু প্রথম যে ভাষাটি শেখে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা আজও মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ নামক ম্যাক্সিম আউড়ে গেলে বেশ চাপ। তাও যদি বা ধরি মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ, আমাকে একটু বলতে পারেন, অন্য ভাষায় অশিক্ষার অর্থ কীভাবে মাতৃভাষায় প্রেম হতে পারে? আজকে আমি হিন্দি শিখব সেটা রাষ্ট্রভাষা বলে নয়(সবাই জানে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, অষ্টম তফশিলে বাইশটা ভাষা ইত্যাদি, যদিও সবাইকে বাকি একুশটা ভাষার নাম বা সংবিধান নিয়ে দুচারকথা বলতে বললে বেডপ্যান দিতে হবে), সেটা প্রেমচন্দের বা হরিশচন্দ্রের ভাষা বলে; উর্দু শিখব গালিবের জন্য, ইংরিজি শিখব কিটস পড়ব বলে। নিজের অশিক্ষা/অক্ষমতাকে মাতৃভাষার প্রতি প্রেম(তাও যদি সেটাও জানতাম, হায়রে!) দিয়ে ঢাকতে চাওয়া নিজের দেশের অক্ষমতাকে দেশপ্রেম দিয়ে ডিফেন্ড করারই আরেক পিঠ। আরে ভাই, গোটা দেশে না হোক, তার একটা বৃহত্তর অংশে হিন্দি (মানে ওই বিভিন্ন হিন্দির জগাখিচুড়ি আরকী) কমন ল্যাঙ্গুয়েজ, নিজের রাজ্যের বাইরে গেলে আমি কোন ভাষা বলব? এসপেরান্তো? ইংরেজি নিয়েও একই বক্তব্য। আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে আমি ইংরেজি শিখব না, কেন? না, আমি সাচ্চা ভারতীয়, যে তথাকথিত 'কলোনিয়াল হ্যাংওভার'এ ভুগি না। এদিকে যে ইংরেজি পড়তে গিয়ে কাপড়েচোপড়ে করেছিলাম, সেটা বলতে ফাটে, মানে বুক। তাই চেপে যাই। ওহে অন্ধ বাঙালি, এমনকী তোমাদের রবিদাদু, যাঁকে নিয়ে তোমরা ঘর সাজাও(কারণ অত মোটা রচনাবলী কে পড়বে!), তিনিও ইঞ্জিরিতে লিখেই নোবেল পেয়েছিলেন। ইঞ্জিরি জানার মধ্যে দোষ নেই কোনো! একটা ভাষা জানা মানে বাকি ভাষাকে অপমান করা নয়!
বাঙালি যেমন এরকম উজবুকের মতো কাজ করে, বাঙালি ততোধিক বেশি উজবুকের কাজ করে নিজের রাজ্যে অন্য ভাষা বলে। তখন না পারা গুলো সব 'পারা' হয়ে যায়। তখন বাঙালি পারলে অ্যাংকেও 'মিলিপিপ্পিং খ্রুক?' বলে সম্বোধন জানায়। বাঙালি হিন্দিভাষীকে ভুল হিন্দি, বিদেশিকে ইয়েস নো গুডমর্নিং বলবেই। পারুক, না পারুক, বলতেই হবে। আমরা সুযোগ পেলেই হিন্দিমেশানো বাংলা, ইংরেজিমেশানো বাংলা বলবো, আবার অঞ্চলভিত্তিক লোকনিরুক্তি-মিশ্রিত ডায়ালেক্টের ডায়ালগ শুনলে ছোট্টুলালকে কমপ্লেক্স দিয়ে 'খ্যাঁ খ্যাঁ খৌয়া খৌয়া' হাসি হাসবো - কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মান্যভাষাকেই কেবল 'বাংলা' বলে ধরে নেবো - যে বাঙালি মাতৃভাষা নিয়ে এত সচেতন, একটু নিজের কেরামতি দেখানোর সুযোগ পেলে সেই মাতৃভাষা প্রেম কোথায় যায়, ভগবান জানে। নিজের রাজ্যে আমি আমার ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় কেন কথা বলব? তাতে আমার মাতৃভাষার প্রতি ভারী সম্মান দেখানো হচ্ছে? নাকি ভুল ইংরিজি, হোঁচট খাওয়া হিন্দি বললে ভারি বিশ্বনাগরিকত্ব দেখানো হয়?
একটাই বক্তব্য। ভাষা নিয়ে কোনো রিজিডিটি দেখানোটা বোকামো এবং অশিক্ষার পরিচায়ক। যে ভাষাই বলব/লিখব/জানব, সেটা ভালো করে জানব/লিখব/শিখব/বলব, সে ছাই মাতৃভাষা হোক আর ভ্রাতৃভাষা, একটা ভাষা হোক কি একান্নটা। এটুকু যেন মাথায় রাখি, তাহলেই রফিক-বরকতদের প্রতি, সমস্ত ভাষাশহীদদের প্রতি, ভাষার প্রতি সম্মান জানানো হবে। 😊
Comments
Post a Comment