নব জন্মদিন

একেকটা জন্মদিন আসলে নিজের মৃত্যুদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, এমনটা শুনেছিলাম। হয়তো তাই। বহতা জীবন, বহতা এই নদী, তার শেষ আছে। সকলই ফুরায়, ফুচকার প্রায়, পড়ে থাকে শালপাতা। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, আমার জীবনে এই শালপাতা কী? শুধুই কি আমার স্মৃতি? আমার আমিটা থাকবে না? আমি লেখক নই, মাইকেল বা শেকসপীয়রীয় দাবি জানিয়ে যেতে পারবোনা, যে আমার লেখা থাকবে, তা যুগে যুগে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কিন্তু, এই যে আমি, হাটেবাজারে চালালু কেনার গোষ্ঠিক পরিচয়ের বাইরেও যে একটা ব্যক্তিক পরিচয় আছে আমার, সেটা কী দিয়ে রেখে যাব? লেখাই কি শ্রেষ্ঠ নয়? আর যে আমি কিছুই পারি না! লেখাও যে পারি, এমনটাও নয়। তবু অসংখ্য না-পারার মধ্যেও যে কিছু পারাটুকু পড়ে থাকে, তারমধ্যে লেখাটুকুই একমাত্র আশ্রয় বলা যেতে পারে।


এবার প্রশ্ন হচ্ছে, লিখবো, তো লিখবো কী? কবিতা? সে লেখা তো সোজা, --


''আকাশেতে ছিলো পাখি

  উড়তো একা একা

  একদিন সে পড়লো কেটে

  পেলো না কেউ দেখা..'

নাহ্, মিলে যাচ্ছে। মিলে গেলে তা কবিতা নয়। খবিতা, গবিতা, ঘবিতা, নিদেনপক্ষে ঙবিতা বা চবিতাও হতে পারে, তবে কদাচ কবিতা নয়। তবে.. 


'আকাশের গায়ে লেগে থাকে পাখির ডানা

তার সোচ্চার ডাক যেন তালিবানের বন্দুকের গুলি

একদিন সে পেড়েছিলো ডিম

লোকে ভাবে উগ্রবাদী বোমা

বোমা দেখে লেগে যায় দাঙ্গা

মানুষের কান্না মরুভূমি হয়ে ওঠে...'



হ্যাঁ, এটা খানিকটা হয়েছে। পাখি আছে, তার সোচ্চার ডাক আছে, তালিবান সমস্যা রয়েছে, ডিম রয়েছে, লোকের বোমা ভাবাও রয়েছে, তাতে দাঙ্গা, মানুষের কান্না, মরুভূমিও রয়েছে। বিশ্বসমস্যার কথা লিখেছি। এবার শুধু লিটল ম্যাগাজিন ধরে ছাপানোর অপেক্ষা। কিন্তু, নাম কী দিই? 


'ঙর্ঘৎহৃয' - এই নামটা বেশ ভালো। বোধগম্য নাম হলে ভালো লাগে না।


ধুর, এতো সোজা জিনিস লিখতে ভাল্লাগে না। তবে কি.. গল্প লিখব? গল্প লেখাও সোজা। একটা দম্পতি থাকবে, তাদের কোভিড হবে, তারা মরে যাবে, কিন্তু মরার আগে তারা জানতে পারবে তাদের আরেকটা করে বিয়ে আছে, তারাও কোভিডে মারা গেছে। হুঁ হুঁ বাবা, দেশ ছাপলো বলে। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলতে হবে, নইলে আমি তো খুব বড়ো লেখক, আমার লেখা 'চুরি' হলো বলে। আলুচুরিমুলোচুরি ছেড়ে লেখাচুরি এখন বড়ো ব্যাপার। সবার লেখা চুরি হচ্ছে। 



কিন্তু, লিখিটা ঠিক কী? প্রবন্ধ? 


'এতদ মুমূর্ষু কিয়ৎ প্রদ্যোত কিয়ৎ অভ্রংলিহ হর্ম্ম্যরাজি চার্বাক, অর্হৎ আর্ষপ্রয়োগ কিঞ্চিৎ কুজ্ঝটিকা অলত্র ভুসুকু? বৈরী অগ্নিমীলে রাজ্ঞী কুর্বক, দ্যুঃ ম্রিয়ত কপোতাক্ষ।'


এই প্রবন্ধটা একটু সোজা হচ্ছে। আরেকটু কঠিন দেখি।


'আসলে ফ্রয়েড যেটা বলেছিলেন, সেটা লিখতে হলে দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন থিওরি চাই। বাখতিন বিড়ি খেতেন না, এই মর্মে গ্রামসির যে পোস্টকলোনিয়াল ছড়াটা আছে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেছিলেন চমস্কি(চমচম থেকে চমস্কি - চমৎকার প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৬৯)। ব্যাপারটা হলো, যখন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা তান ধরেছিলেন, তখন নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, বাঙালি পিৎজায় পাইন্যাপল খায়। পিৎজায় পাইন্যাপল আমরা দেখতে পাই ফেলিনির লা দোলচে ভিতায়, যেটা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কীভাবে কমিউনিস্ট উপেনের ভিটা চলে গেছিল (লা দলচে থেকে উপেন - ভিটা থেকে ভিতার পোস্টমডার্ন, পোস্টকলোনিয়াল, পোস্টমর্টেম ও পোস্টঅফিস বিশ্লেষণ, অত্যাধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ১০৮)। 

আমাদের বুঝতে হবে, সার্ত্রে ঠিক কী কী কারণে লুঙ্গি পরতেন না, তার জন্য মিলের উপযোগিতাবাদ ঠিক কতটা দরকারি। আলড্যুস হাক্সলের হ্যাল খাওয়ার ফলে ১৯২৯ এর বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দায় কীভাবে হাংরি জেনারেশন প্রভাব ফেলেছিল, তার প্রপঞ্চের ব্যাখ্যামূলক দ্বন্দ্ববাদ আমাদের শেখায়, কেন সোনম গুপ্ত বেওয়াফা। মধুশ্রী মুখার্জি চার্চিলের ব্যাপারে বলতে গিয়ে চার্চিলের সব চাল খেয়ে ফেলার যে দাবিটা জানিয়েছেন, সেই দাবিটা নিয়ে নীৎশে বলেছেন, ভগবান মৃত, আর রোঁলা বার্থ ইজ্ ডেড। জরাথ্রুষ্ট তাতে রুষ্ট হয়েছেন, তার পেছনে বিরোধীদের যে আর্থসামাজিক হাত রয়েছে, সেটা কিন্তু সুস্পষ্ট দেখা গেছে বার্গম্যানের সেভেন্থ সিলে। মৃত্যু এসে দাবা খেলছে, আর মানিকদা লাফাচ্ছেন 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' বলে। বাকিটা স্বতঃসিদ্ধ, অনেকটা শ্রোডিঞ্জারের বেড়াল মজন্তালি সরকারের মতো।'



এইটাও বেশ সোজা হল। তাহলে....


নাটক? 


'রাজা - নন্দিন, তোমাকে ভাবছি মনে, আর হচ্ছি রোগা দিন দিন।

নন্দিনী - উঁহ, মিনসের মুখে জুতো।

রা - দাও মম মুখে জুতো, তবুও যে পাবো তোমাকে চুমু খাওয়ার ছুতো!

বিশু পাগলা - এইও রাজা! কিছু কিছু দুঃখ আছে, যাকে ভোলার মতো দুঃখ আর নেই!

রা - কিন্তু আমি তো সেটা...

বি - চোপরাও! বলছি না, কিছু কিছু দুঃখ আছে, যাকে ভোলার মতো দুঃখ আর নেই?

রা - কিন্তু আমি..

বি - চোপ শালা ক্যাপিটালিস্ট জালের আড়ালে থাকা মাল, বুঝছিস না, কিছু কিছু দুঃখ আছে, যাকে ভোলার মতো দুঃখ আর নেই??

(ইউকুলেলে বাজিয়ে 'তোমায় গান শোনাব' গাইতে গাইতে প্রস্থান)

রা - শালা, এ ক্যামন পাঁচ অক্ষরের পাগল? দেখে যেন মনে হয় নন্দিনের বাঁধা ছাগল!

(হঠাৎ এক প্রৌঢ়ের আবির্ভাব)

ন - এ কী, রঞ্জন! তুমি বেঁচে? এরকম গোলগাল, টাকমাথা কীভাবে হলে? ওগো, তুমি তো যৌবনের দূত, আমার পান্তোভূত!


অধ্যাপক(পাশ থেকে হঠাৎ এসে) - ধুত্তোর, এ তোমার রঞ্জন না। ইনি বেস্টসেলার লেখক। যেখানে খুশি সেখানে যান স্বেচ্ছায়, এবার তোমাকে রাজাকে জড়াবেন কেচ্ছায়। 

ন - অ! দিতে হয় খ্যাংরা দিয়ে পিটিয়ে!

রা - তোমার হাতের খ্যাংরা, আহা, যেন বেগুন বড়ির ঝোলে ট্যাংরা!

ন - এই কে আছিস, এই দু'পয়সার অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিকে থামা তো! 

রা - আজকে আমায় থামায় কে? আজকে বড়ো সুখের দিন, নাচব আমি আর নন্দিন!


ন - ইল্লি? আমি কি বাসন্তী নাকি, করছিস শুধু খিল্লি?

(মোড়ল আর গোঁসাইয়ের প্রবেশ)

মোড়ল - বাজা তোরা রাজা যায়!

গোঁসাই - আহা, কী শান্তি। মা নন্দিন, এদিকে আয় মা।

ন - তুমি কে বাবা? দেখে তো মনে হচ্ছে আশারাম বাপু!

গোঁ - না মা, আমি শুধু বাণী দিই।

ন - ও, সন্দীপ মাহেশ্বরী টাইপ। ইউটিউব চ্যানেল আছে? কটা টেড টক দিয়েছো?

গোঁ - আহারে, অবলা নারী। নারীর ভাষা কিছুই বোঝা যায় না। এইজন্যই নারীরা পদতলে থেকে গেলো।

ন - এসব আলফাল বকলে এমন পোস্ট ছাড়ব না ফেসবুকে, তোমার স্ক্রিনশট নিয়ে লোকে লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রেখে দেবে, তখন সব ইয়ে বেরিয়ে যাবে!

গোঁ - না ভাই, এ বড়ো কঠিন ঠাঁই। আসি রাজাদা। চলো মোড়ল ভাই। 

মো - চলুন গোঁসাই। বাজা তোরা, রাজা যায়।

রা - ধুত্তেরি, এদের চক্করে নেই প্রাইভেসি, শুধু চ্যাংড়ামি বেশি বেশি। নন্দিন, চলো আমরা ওইখানে যাই, যৌবনের গান গাই। 


(মালা যে তার ভরেছে তার পাকা ফসলে গাইতে গাইতে প্রস্থান রাজা ও নন্দিনের)।'



এটাও সোজাই হচ্ছে। আচ্ছা, লোকে যে তাহলে বলে লেখা নাকি কঠিন? আমার তো বেশ সোজাই লাগছে। শেষ একবার ফেবুকবিতা ট্রাই করে দেখি...


'তোমার আদরের দাগ আমার ডানায় লেখা আছে

যেমন লেগে থাকে পিরিয়ডের রক্তের দাগ।'


এটা বরং একটু কঠিন। পিরিয়ড না আনলে ফেবুকবিতা হয় না, আর পিরিয়ড তো মাস না ফুরোলে আসবেও না। বড্ড বেশিই কঠিন। যদি হই, ফেবুকবিই হবো, মনস্থির করলাম। ওগো কাব্যদেবী, 


ফুটি যেন ফেবুতলে, মানসে মা যথা ফলে, 

মধুময় ফেবুকবি, কী বসন্ত, কী শরদে।



আজ আমার নব জন্মদিন হলো, ফেবুকবি রূপে। শুভ জন্মদিন, কবি। 😊

Comments

  1. এ তো কবির বাণী নয় গো,
    হে বন্ধু হে প্রিয়,
    পড়ে কারও জ্বলুনি হলে
    বরফ ঘষে দিও!

    ভাল লিখেছিস!

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts