পোচিসে বোইসাখ...

 আজকে দাদুর জন্মদিন.. 🥳🥳 শুভ জন্মদিন দাদু.. তোমাকে ছাড়া বাঙালি হাগতেপাদতেকাঁদতে.. (এর সঙ্গে মিলিয়ে আরো একটা জিনিস হয়, লিখলাম না আর, বুঝ লোক জান যে সন্ধান😛) পারত না.. তোমার কবিতা শুনে সকালে উঠি, তোমার উপন্যাস পড়ে রাতে ঘুমোই(নিন্দুকেরা বলে এত বাজে উপন্যাস যে পড়লেই ঘুম পেয়ে যায়), তোমার গান গেয়ে কাজ শুরু করি। 


কী করোনি বলো তো দাদু! সেই ছোটো থেকে তুমি বাড়ির চাকরদের ইয়ে জ্বালাতে, যে জন্য তোমাকে শ্যাম চাকর আটকে রাখত খড়ির গণ্ডি এঁকে - এর বাইরে বেরোলেই উত্তাল ক্যালানি। তুমি চুপচাপ বসে জানলার বাইরে মেয়েদের স্নান দেখতে। লোকে যে বয়সে হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরে, সেই বয়সে তুমি একটা কেচ্ছা করে দিলে! লাস্টে রঞ্জন বাঁড়ুজ্যে সেটা বেচে বেস্টসেলার করে নিল.. যাই হোক, সেসবে গিয়ে আর লাভ নেই...

জমিদারি সামলাতে গেলে, গিয়ে শুধু ফাটিয়ে কবিতা আর ছোটোগল্প লিখলে, আর ভাইঝিকে চিঠি লিখে গেলে। যদিও তুমি কাকা হেব্বি বুদ্ধিমান, এমন কিছু চিঠিতে লিখলেই না, যেটা প্রকাশ পেলে আবার স্ক্যান্ডাল। আগেকার দিনে তো স্ক্রিনশট ছিল না, তা সত্তেও তোমার এর'ম সাবধানতা.. তুমি সত্যিই সেরা। সারাজীবন নারীদাড়িগাড়ি নিয়ে থেকে গেলে.. আর কিছু লেখা লিখলে, বাপরে! এত লেখা একটা মানুষ তার জীবদ্দশায় পড়ে শেষ করতে পারে না, আর তুমি সেটা লিখে ফেললে??? কোন এক মারোয়াড়ি বলেছিল, সুধু কাগোজ আর কোলোমের বেওসা কোরে উনি লাখো কামায় নিলেন। আর তোমার প্রেম! আগে নাবিকদের বন্দরে বন্দরে বৌ থাকত, তোমার প্রেমিকা থাকত দেশে দেশে.. শেষমেশ আর্জেন্তিনাতেও!!! লোকে আর্জেন্তিনা চেনে মেসির জন্য, তুমি চেনালে ওকাম্পোর জন্য!! এইসব দেখেই গান্ধীজি তোমাকে 'গুরুদেব' বলে ডাকতেন। গান্ধীজি শুধু কুমারী মেয়েদের নিয়ে ব্রহ্মচর্য প্র‍্যাকটিস করতেন, তুমি সেসবেরও ঊর্ধ্বে - নইলে গুরুদেব হলে কীভাবে! সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর। তোমার থেকে শেখার, জীবনে এত ম্যাডাম ক্র‍্যাকারোলজির পরেও তোমার নামে কেউ #মিটু কীভাবে করেনি। কী তব চার্ম, কেউ করতে পারেনি তোমার ফেমের হার্ম? তোমার বিরোধী গোষ্ঠী তোমাকে 'আধুনিক নও' মর্মে খিস্তি মারছে বলে একটা অসাধারণ রকমের যাচ্ছেতাই উপন্যাস লিখে ফেললে, যেটার শুরু থেকে শেষ একই রকমের খাজা! যদিও তুমি গুরুদেব, তুমি বুঝেছিলে বহু বছর পরে ওটা পড়ে সমগ্র বাঙালি আঁতেলগোষ্ঠীর সম্মিলিত অর্গ্যাজম হবে। লহ প্রণাম গুরুদেব, লহ প্রণাম।


জোকস অ্যাপার্ট, বাঙালি নামক এই থার্ডক্লাস জাতের গর্ব হওয়া উচিত, রবীন্দ্রনাথ আমাদের। রবীন্দ্রনাথের দর্শন, রবীন্দ্রনাথের দর্শনের যাত্রা, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ, স্বদেশচেতনা.. কী ছেড়ে কী নিয়ে লিখি? যদি উনি শুধুই ছোটোগল্প, বা শুধুই গান, বা শুধুই কবিতা, বা শুধুই নাটক লিখতেন, আর কিচ্ছুটি না করে, তাহলেও রবীন্দ্রনাথ উৎকর্ষতার শিখরেই থাকতেন, তাঁর প্রভা কিছুমাত্র কমত না।

ছোটগল্প নিয়ে বলি একটু। রবীন্দ্রনাথের মতো ছোটোগল্পকার বিশ্বসাহিত্যে বিরল। ওরকম অসাধারণ ঠাসবুনোন, ক্লাইম্যাক্স রচনা, ক্যাটাস্ট্রফিতে এসে সজোরে ধাক্কা, অসামান্য মেটাফর এবং ইমেজারির প্রয়োগ - এবং, সর্বোপরি, জীবনের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অধ্যায়ের উপর লাইমলাইট ফেলে একটা সার্বজনীনতা প্রদান - এর তুলনা থরে-বিথরে পাওয়া যায়, এমনটা আমার জানা নেই অন্তত। আবার, উনি ছোটোগল্পের টেক্সটবুক সংজ্ঞা ও উদাহরণ - এমনটা ভাবাও ভুল। যেকোনো শ্রেষ্ঠ শিল্পী মাত্রেই তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করেন, রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর ছোটোগল্পের উৎকর্ষতার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। 

'পোস্টমাস্টার' আশা করি সকলেরই পড়া। আমি নিশ্চিত, বিশ্বসাহিত্যের যেকোনো লেখক 'পোস্টমাস্টার'এর মত একটা ছোটোগল্প লিখতে পারার জন্য নিজের ডানহাতটুকু অবধি কেটে দিতে রাজি হবেন। পোস্টমাস্টার শহরের প্রতীক, রতন গ্রামের। পোস্টমাস্টার রতনকে পড়াতে পড়াতে 'অল্পদিনেই যুক্ত-অক্ষরে উত্তীর্ণ' হওয়ার একটা প্রসঙ্গ আছে। যুক্তাক্ষর নয়, যুক্ত-অক্ষর --- একটা হাইফেনের দূরত্ব, একটা ব্যবধান, যে ব্যবধান বুঝিয়ে দেয় পোস্টমাস্টার এবং রতন কখনোই এক হতে পারলেন না, পারেন না। শহর আর গ্রাম কাছে আসতে পারে, তারা মিলিত হতে পারে না -- এই ট্র‍্যাজেডিটাই আবার তুলে ধরেছেন তিনি শেষ প্যারাগ্রাফে, যেখানে রতন ওরফে গ্রাম নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শহরের ফিরে যাওয়া - মাঝে একটা প্রতিশ্রুতি, একটা আশ্বাস, একটা কথা দিয়ে না রাখার ব্যবধান, যার ফলে যুক্তাক্ষর অনেকটা ব্যঞ্জনা নিয়ে যুক্ত-অক্ষর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। 

এ'রকম লেখা যিনি লিখতে পারেন, তিনি মানুষ নন।

তাঁর কবিতা বা গান নিয়ে না'হয় নাই বা বললাম। সেই নিয়ে তো হুজুগ করার লোকের অভাব নেই। শুধু এটুকুই, যে জীবনের শুরুর দিকে তিনি বসে লিখছেন 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ', মাঝবয়েসে এসে লিখছেন 'সোনার তরী' শেষ মুহূর্তে এসে যিনি 'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি' -- আত্ম থেকে ব্রহ্মের দিকে এই যাত্রা, এই অসীমের যাত্রা, এই উপলব্ধি, ক'জন পারে? তাঁকে যে ঋষি বলা হয়, তা কি অমূলক? সাহিত্যমূল্যে না'হয় বা নাই গেলাম।

আবার, নাটক? রক্তকরবী? রক্তকরবী কি শুধুই রাজার  বিরুদ্ধে রঞ্জনের জেহাদ? রক্তকরবী কি শুধুই সেই জানলার বাইরে দিয়ে তাঁর দেখতে পাওয়া, লোহালক্কড়ের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠা রক্তকরবীর ফুল? রক্তকরবী কি এখনকার যুগে প্রযোজ্য নয়? 'ডাকঘর'? 'অচলায়তন'? নাট্যদ্বন্দ্ব ইত্যাদি লিটারারি ডিভাইস না'হয় তুলে রাখলাম আবারও। বেশ। কিন্তু তাঁর চিন্তন, তাঁর মনন, তাঁর ভাবনা? লিখতে তো সবাই পারে, কিন্তু প্রাসঙ্গিক, কালজয়ী হন ক'জন? বিশ শতকের শুরুর দিকে বসে একটা লোক কী ছাইপাঁশ লিখে গেল, আমরা একুশ শতকে পড়ে ভাবছি, এই ভাবনা কীভাবে সম্ভব? এখনও কীভাবে এগুলো এতটাই সত্যি? 'বিদূষক' পড়ে আমরা সকলেই আমোদ পাই, বাহ্ কী মজার গল্প! কিন্তু এটা বুঝি না, কীভাবে তিনি বুঝেছিলেন ও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, রাষ্ট্র কীভাবে ইতিহাস গড়ে তোলে, কীভাবে ইতিহাস রচনা করে। জাপানি আগ্রাসন সম্পর্কে ব্যথিত হয়ে বলতে পারেন 'ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে, আর ভক্তির বাণ বুদ্ধকে' - তিনি অতিমানব। যিনি ঘরে-বাইরের মত উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে একটা অসাধারণ মেটাফর নিয়ে আসতে পারেন, শেষের কবিতা'য় নিজের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে নিজেই ব্যঙ্গ করছেন, তিনি কি সাধারণ? বলছেন, অতিমানব নন?

আর কত বলব? কাগজ ফুরিয়ে যাবে, ওনার লেখার ব্যাপারে বলা ফুরোবে না। রবীন্দ্রনাথ আসলে তাঁর লেখা ঘরে-বাইরের সেই রঙিন কাঁচ লাগানো বারান্দা, যার মধ্যে দিয়ে আলো এসে ঝিলমিল করে, আর তাঁর চরিত্রের বিভিন্ন শেডগুলো এসে ধরা দেয় তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, আর আমরা ধন্য হই। আফশোস এটাই, রবীন্দ্রনাথ যেটা নিজে পছন্দ করতেন না, আমরা রবীন্দ্রনাথকে সেই স্যাক্রোস্যাংটই করে রেখে দিলাম, মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী হয়ে গেলাম, গোঁড়া হয়ে উঠলাম। মলয় স্যার, আমাদের অতি প্রিয় মলয় রক্ষিত স্যার একবার লিখেছিলেন(খেয়াল আসছে না সেটা অন্য কারোর কথা না ওনার নিজের), "কবিগুরুকে আমরা ড্রইংরুমে সাজিয়েই রাখলাম, নিতে পারলাম না।"

Comments

  1. ভাই খিল্লি করে দিলি

    ReplyDelete
  2. এবারে বেশ হোঁচট না খেয়ে পড়া গেল। ভাল লাগছে। ড্রইংরুমের বাইরে লোকটাকে এই সহজ দৃষ্টিতে দেখলেই দেখা যাবে ভাই। না হলে সবটাই বৈশাখ মাসে শীতের নাচন মার্কা ট্রাফিক সিগনাল হয়ে যাবে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts