ঠিকানাহীন চিঠি - ৮
প্রিয়তমা,
হাসপাতালের বেডে বসে(মানে শুয়ে) এটা লিখছি। ফোনেই বলতাম৷ কিন্তু, কথা বলতে একদমই পারছি না। কথা বলতে গেলেই মনে হচ্ছে, কেউ গলা টিপে ধরছে। বুকে, গলায় প্রচণ্ড চাপ লাগছে। তাই, কলম, মানে নোটপ্যাডই ভরসা।
কেমন আছ তুমি? জানি, বলবে, 'ভালো আছি'। বলবে 'আমার কথা ছাড়ো। তুমি কেমন আছ? তুমি ভালো আছ তো? দেখো, ঠিক ভালো হয়ে উঠবে তুমি।' কিন্তু আমি জানি, তুমিও ভালো নেই। যে অনিবার্য সত্যিটার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছ, সেই আশঙ্কা তোমাকে ভালো থাকতেই দিচ্ছে না। কিন্তু তোমাকে হাসি ফুটিয়ে অভিনয় করে যেতেই হচ্ছে। কী আশ্চর্য, না? তুমিও চাইছ, কান্নায় ভেঙে পড়তে, পারছ না। আমার জন্যই পারছ না। যাতে আমি ভেঙে না পড়ি।
কেন এরকম হল বলো তো? কেন এরকম হয়?জীবনটা আসলে সিনেমার মতো; সবসময়ে যে সব 'হ্যাপি এন্ডিং' হবে, তা নয়। সব ঠিক করে চলে, হয়, সব জিনিস সময়ে চলে আসে, কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন হয়। আর যখন হয়, তার ধাক্কা সামলাতে পারি না আমরা।
অথচ, কত স্বপ্ন ছিল আমাদেরও। হ্যাঁ, 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি'-মার্কা সুখটুখ না থাকলেও, দুঃখও কিছু ছিল না। এইটুকু বয়েসে কীইবা চাওয়ার থাকে? প্রেম, ঝগড়া, অভিমান, জীবনকে শেষটুকু অবধি নিংড়ে নেওয়া, একসঙ্গে কেরিয়ারের স্বপ্ন দেখা, সংসার-ফ্যামিলি প্ল্যানিং-সন্তান-সন্ততি, যথাসম্ভব বিলাসবহুল জীবন কাটানোর স্বপ্ন.. ব্যাস, এইটুকুই.. উচ্চ-মধ্যবিত্তের স্বপ্ন এই সিলিং-এ এসেই ধাক্কা খায়। আমরাও কিছু ব্যতিক্রমী ছিলাম না। কিচ্ছু তো এমন হাতিঘোড়া চাইনি। হ্যাঁ, হয়তো প্রত্যেকটা স্বপ্ন পুরো হত না, কিন্তু আংশিক হত? সুখে থাকতাম? ভালো থাকতাম?
জানো, যখন কলেজে সদ্য সদ্য ঢুকেছিলাম, খুব সুইসাইড বাতিক ছিল, কলেজের আর পাঁচটা ছেলেমেয়েরই মতো। হ্যাঁ, বাতিক শব্দটা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে, তাতে তাদের ট্রমাকে ছোটো করে দেখা হচ্ছে ভেবে। কিন্তু যারা নিজের ট্রমাকে সর্বক্ষণ যাচ্ছেতাইভাবে পাবলিক করে, কমোডিটি হিসেবে বেচে বেড়ায়, তাদের ট্রমা আর যাই হোক, ট্রমা নয়। সব সত্যি মুখের উপর বলা যায় না, সেন্সিটিভ ব্যাপার বলে। যাকগে। আমারও ওরকম 'আমার না, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে' বেচার অভ্যেস ছিল। দুয়েকবার অ্যাটেম্পট নিতে গেছিলাম, 'সত্যিকারের' ডিপ্রেশনে, 'সত্যিকারের' ট্রমার শিকার হয়ে। পারিনি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি বার বার, এবং যখনই পিছন ফিরে তাকিয়েছি, মৃত্যুর চোখে চোখ রাখতে পারিনি। পারা যায় না। মৃত্যুর মুখে চোখে চোখ রাখা যায় একরকম বেপরোয়া হয়ে, যখন আমরা জানি, আর কিচ্ছুটি করার নেই। আমরা চেষ্টা করি, না করি, আমাদের কিচ্ছুটি করার নেই। যখনই ওই 'কিচ্ছু'টি করে ফেলার ন্যূনতম আশাটুকু থাকে, তখনই আমরা আর বেপরোয়া হতে পারি না। নইলে, যতই রবীন্দ্রনাথ লিখুন না কেন, 'আমি মৃত্যু চেয়ে বড়', কেউই মৃত্যুর থেকে বড়ো না। হতে পারে না। এত বড়ো অমোঘ সত্যি বোধহয় আর কিচ্ছুটি হয় না। হতে পারে না। তার চোখের দিকে চোখ রাখতে কেবল সব-হারানো মানুষটাই পারে। যখনই আমি ফিরে আসতে পেরেছি মৃত্যু ছুঁয়ে, নিজেকে প্রবল ভাগ্যবান ভেবেছি। হায় রে! কী যন্ত্রণায় যে মানুষ মৃত্যু বেছে নেয়... যারা বেঁচে থাকে, তারা জানে না, যে তারা কতটা ভাগ্যবান। কী জিনিস যে তারা হেলাফেলা করে কাটাচ্ছে.... People take life for granted।
পৃথিবীটাই হঠাৎ কেমনভাবে বদলে গেল, না? কেমন আস্তে আস্তে হিংসাত্মক একটা জায়গায় চলে গেলাম আমরা। পৃথিবী বরাবরই হিংসাত্মকই ছিল; কিন্তু এখন যেন কেমন সবাই মুখদাঁত খিঁচিয়ে হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যেন ১০০ বছর আগে পিছিয়ে গেছে। এক নোংরা সাম্প্রদায়িকতার শিকার আমরা। তার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, বাণিজ্যযুদ্ধ, ঠাণ্ডাযুদ্ধ, পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি... তারসঙ্গে নতুনভাবে যোগ দিল এই উহান ভাইরাস। সরি, পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে হবে, করোনা ভাইরাস বলে। তুমি ইবোলা(কঙ্গোর নদী) বলো, নিপা(মালয়েশিয়ার গ্রাম) ভাইরাস বলো, হান্টা ভাইরাস (সাউথ কোরিয়ার হান্টান নদী) বলো, তাতে রেসিজম নেই। কিন্তু একবার উহান ভাইরাস বলো, তুমি রেসিস্ট কাস্টিস্ট সেক্সিস্ট মিসোজিনিস্ট পাঁউরুটির ইস্ট সব। কেন একটা দেশের সরকার সব তথ্য লুকিয়ে রেখেছিল, কেন দু'মাসের বেশি সময় ধরে কোনোরকম চেষ্টা করা হয়নি একটা মারাত্মক সংক্রামক ভাইরাসকে একটা দেশের মধ্যেই আটকে ফেলার, কেন যেসব ডাক্তাররা শুরুতেই সবাইকে সাবধান করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা নিঁখোজ হয়ে গেলেন, বা কেনই বা পেশেন্ট জিরোর সব রেকর্ড মুছে ফেলা হল - এসব জিজ্ঞেস করবে না। কেন সার্স এর মতো একটা রোগ একটু সেরে উঠতেই আবার ওয়েট মার্কেটের উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, এসবও জিজ্ঞেস করবে না। এমনিতে চিন খুবই ভালো দেশ, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান এবং চিনের ভাইরাস আমাদের ভাইরাস। হিন্দি চিনি ভাই ভাই(রাস)। সে যাগ্গে, সেসব যাক, আমরা একে করোনা ভাইরাসই বলব। কীভাবে একের পর এক দেশের দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে শেষ করে দিল! আমরা সবাই চুপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে গেলাম। চেষ্টা করছে সবাই, সরকার থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা, কিন্তু সবাই জানে, অন্তত এখনো পর্যন্ত, একে হারানো যাবে না। ঠিক যেন একটা বাচ্চাকে একটা গ্লোব আর একটা স্কেচপেন নিয়ে খেলতে দেওয়া হয়েছে; যেখানে পারছে রং দিয়ে দিচ্ছে, আর রাঙানো জায়গাটা হচ্ছে ইনফেক্টেড জায়গা। কখন যে সে থামাবে নিজের প্রলয়মাতন, কেউ জানে না। শুধু তার থামার ভরসায় চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। জানো, মাঝে মাঝে ভাবি, প্রত্যেক একশো বছর অন্তর যে এই মারণরোগের প্রকোপ হয়, সংক্রমণ হয়, এটার দরকার। প্রত্যেক একশো বছরের মধ্যেই মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এই বিশ্বচরাচরের মাঝে ধূলিকণার থেকেও ক্ষুদ্র, আণুবীক্ষণিক এক জীব যে মানুষ, এটা সে বিস্মৃত হয়ে, আর তারই ফলস্বরূপ এই মহামারী। যাতে প্রত্যেক একশো বছরে মানুষকে মনে করানো যায়, যে সে কিচ্ছু না। কিচ্ছুটি না। একটা তুড়ি, সে শেষ।
এরমধ্যে কিছু লোক আবার দাবি দিচ্ছে, সব মানুষ মরে যাক, গাছপালা পশুপাখি হেঁচেকেশে বাঁচবে, রূপ খোলতাই হবে, মানুষ যাচ্ছেতাই প্রাণী, সবাইকে কেটেছেঁটে ফেলে। মানছি, আমাদের অনেক দোষ। কিন্তু সেগুলোকে ঠিক করার চেষ্টা না করে, এবং যে লোকগুলো কিছুই করেনি, উল্টে গাছপালা পশুপাখি বাঁচানোর চেষ্টা করেছে ও করছে, তাদের মেরে ফেলে কী লাভ হবে?? যদি মানুষই না থাকে, তাহলে বৌ-কথা-কও-এর গান কে শুনবে? কুমির? নাকি লজ্জাবতী লতার পাতা ছুঁয়ে দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে একটা খ্যাঁকশিয়াল? নাকি প্রজাপতির ডানার রঙ দেখে চোখ ঝিলমিলিয়ে যাবে একটা জলহস্তির? কিছুই না, বাকস্বাধীনতার দরকার যেমন আছে, তেমন তা খর্ব করারও দরকার আছে। কিছু লোকের জিভ, পেন আর কিবোর্ড কেড়ে নিলে জগৎটারই আখেরে মঙ্গল।
এই অদ্ভুত কিসিমের জগৎ, এত হতাশা, এত রোগব্যাধি, দুরাশা, খুনোখুনির মধ্যেও, তুমি ছিলে, এবং, তুমিই আছ। অদ্ভুত এই, কালও তুমি থাকবে, হয়তো এই জগৎটাও; কিন্তু আমি হয়তো আর থাকব না। অথচ, এমনটা চাইনি, জানো। এখনই ফুরিয়ে যেতে চাইনি। অথচ, ফুরিয়ে যেতে হল। এরকম কতশত স্বপ্ন রোজ কুরবানি যায়, পতাকায় ঢেকে গানস্যালুটের বিলাসিতা ছাড়াই। কীইবা এসে গেল! কীইবা এসে যায়! কতটুকুই বা এসে যায়!
আর লিখতে পারছি না। বুকে কষ্ট হচ্ছে খুব। অক্সিজেনের লেভেল বাড়িয়ে দিল। হয়তো... আর কয়েক ঘণ্টা। তারপরেই হয়তো জানতে পারব, ওই পারের আসল কিস্যাটা আসলে কী।
ভালো থেকো। ভালোবাসা নিয়ো। নিজের যত্ন নিয়ো। বাবামাকে ভালো রেখো, দেখে রেখো।
ইতি,
উহান(মানে করোনা) ভাইরাসের হাজার হাজার শহিদের একজন(আগাম)।
হাসপাতালের বেডে বসে(মানে শুয়ে) এটা লিখছি। ফোনেই বলতাম৷ কিন্তু, কথা বলতে একদমই পারছি না। কথা বলতে গেলেই মনে হচ্ছে, কেউ গলা টিপে ধরছে। বুকে, গলায় প্রচণ্ড চাপ লাগছে। তাই, কলম, মানে নোটপ্যাডই ভরসা।
কেমন আছ তুমি? জানি, বলবে, 'ভালো আছি'। বলবে 'আমার কথা ছাড়ো। তুমি কেমন আছ? তুমি ভালো আছ তো? দেখো, ঠিক ভালো হয়ে উঠবে তুমি।' কিন্তু আমি জানি, তুমিও ভালো নেই। যে অনিবার্য সত্যিটার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছ, সেই আশঙ্কা তোমাকে ভালো থাকতেই দিচ্ছে না। কিন্তু তোমাকে হাসি ফুটিয়ে অভিনয় করে যেতেই হচ্ছে। কী আশ্চর্য, না? তুমিও চাইছ, কান্নায় ভেঙে পড়তে, পারছ না। আমার জন্যই পারছ না। যাতে আমি ভেঙে না পড়ি।
কেন এরকম হল বলো তো? কেন এরকম হয়?জীবনটা আসলে সিনেমার মতো; সবসময়ে যে সব 'হ্যাপি এন্ডিং' হবে, তা নয়। সব ঠিক করে চলে, হয়, সব জিনিস সময়ে চলে আসে, কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন হয়। আর যখন হয়, তার ধাক্কা সামলাতে পারি না আমরা।
অথচ, কত স্বপ্ন ছিল আমাদেরও। হ্যাঁ, 'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি'-মার্কা সুখটুখ না থাকলেও, দুঃখও কিছু ছিল না। এইটুকু বয়েসে কীইবা চাওয়ার থাকে? প্রেম, ঝগড়া, অভিমান, জীবনকে শেষটুকু অবধি নিংড়ে নেওয়া, একসঙ্গে কেরিয়ারের স্বপ্ন দেখা, সংসার-ফ্যামিলি প্ল্যানিং-সন্তান-সন্ততি, যথাসম্ভব বিলাসবহুল জীবন কাটানোর স্বপ্ন.. ব্যাস, এইটুকুই.. উচ্চ-মধ্যবিত্তের স্বপ্ন এই সিলিং-এ এসেই ধাক্কা খায়। আমরাও কিছু ব্যতিক্রমী ছিলাম না। কিচ্ছু তো এমন হাতিঘোড়া চাইনি। হ্যাঁ, হয়তো প্রত্যেকটা স্বপ্ন পুরো হত না, কিন্তু আংশিক হত? সুখে থাকতাম? ভালো থাকতাম?
জানো, যখন কলেজে সদ্য সদ্য ঢুকেছিলাম, খুব সুইসাইড বাতিক ছিল, কলেজের আর পাঁচটা ছেলেমেয়েরই মতো। হ্যাঁ, বাতিক শব্দটা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে, তাতে তাদের ট্রমাকে ছোটো করে দেখা হচ্ছে ভেবে। কিন্তু যারা নিজের ট্রমাকে সর্বক্ষণ যাচ্ছেতাইভাবে পাবলিক করে, কমোডিটি হিসেবে বেচে বেড়ায়, তাদের ট্রমা আর যাই হোক, ট্রমা নয়। সব সত্যি মুখের উপর বলা যায় না, সেন্সিটিভ ব্যাপার বলে। যাকগে। আমারও ওরকম 'আমার না, সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে' বেচার অভ্যেস ছিল। দুয়েকবার অ্যাটেম্পট নিতে গেছিলাম, 'সত্যিকারের' ডিপ্রেশনে, 'সত্যিকারের' ট্রমার শিকার হয়ে। পারিনি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি বার বার, এবং যখনই পিছন ফিরে তাকিয়েছি, মৃত্যুর চোখে চোখ রাখতে পারিনি। পারা যায় না। মৃত্যুর মুখে চোখে চোখ রাখা যায় একরকম বেপরোয়া হয়ে, যখন আমরা জানি, আর কিচ্ছুটি করার নেই। আমরা চেষ্টা করি, না করি, আমাদের কিচ্ছুটি করার নেই। যখনই ওই 'কিচ্ছু'টি করে ফেলার ন্যূনতম আশাটুকু থাকে, তখনই আমরা আর বেপরোয়া হতে পারি না। নইলে, যতই রবীন্দ্রনাথ লিখুন না কেন, 'আমি মৃত্যু চেয়ে বড়', কেউই মৃত্যুর থেকে বড়ো না। হতে পারে না। এত বড়ো অমোঘ সত্যি বোধহয় আর কিচ্ছুটি হয় না। হতে পারে না। তার চোখের দিকে চোখ রাখতে কেবল সব-হারানো মানুষটাই পারে। যখনই আমি ফিরে আসতে পেরেছি মৃত্যু ছুঁয়ে, নিজেকে প্রবল ভাগ্যবান ভেবেছি। হায় রে! কী যন্ত্রণায় যে মানুষ মৃত্যু বেছে নেয়... যারা বেঁচে থাকে, তারা জানে না, যে তারা কতটা ভাগ্যবান। কী জিনিস যে তারা হেলাফেলা করে কাটাচ্ছে.... People take life for granted।
পৃথিবীটাই হঠাৎ কেমনভাবে বদলে গেল, না? কেমন আস্তে আস্তে হিংসাত্মক একটা জায়গায় চলে গেলাম আমরা। পৃথিবী বরাবরই হিংসাত্মকই ছিল; কিন্তু এখন যেন কেমন সবাই মুখদাঁত খিঁচিয়ে হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যেন ১০০ বছর আগে পিছিয়ে গেছে। এক নোংরা সাম্প্রদায়িকতার শিকার আমরা। তার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, বাণিজ্যযুদ্ধ, ঠাণ্ডাযুদ্ধ, পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি... তারসঙ্গে নতুনভাবে যোগ দিল এই উহান ভাইরাস। সরি, পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে হবে, করোনা ভাইরাস বলে। তুমি ইবোলা(কঙ্গোর নদী) বলো, নিপা(মালয়েশিয়ার গ্রাম) ভাইরাস বলো, হান্টা ভাইরাস (সাউথ কোরিয়ার হান্টান নদী) বলো, তাতে রেসিজম নেই। কিন্তু একবার উহান ভাইরাস বলো, তুমি রেসিস্ট কাস্টিস্ট সেক্সিস্ট মিসোজিনিস্ট পাঁউরুটির ইস্ট সব। কেন একটা দেশের সরকার সব তথ্য লুকিয়ে রেখেছিল, কেন দু'মাসের বেশি সময় ধরে কোনোরকম চেষ্টা করা হয়নি একটা মারাত্মক সংক্রামক ভাইরাসকে একটা দেশের মধ্যেই আটকে ফেলার, কেন যেসব ডাক্তাররা শুরুতেই সবাইকে সাবধান করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা নিঁখোজ হয়ে গেলেন, বা কেনই বা পেশেন্ট জিরোর সব রেকর্ড মুছে ফেলা হল - এসব জিজ্ঞেস করবে না। কেন সার্স এর মতো একটা রোগ একটু সেরে উঠতেই আবার ওয়েট মার্কেটের উপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, এসবও জিজ্ঞেস করবে না। এমনিতে চিন খুবই ভালো দেশ, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান এবং চিনের ভাইরাস আমাদের ভাইরাস। হিন্দি চিনি ভাই ভাই(রাস)। সে যাগ্গে, সেসব যাক, আমরা একে করোনা ভাইরাসই বলব। কীভাবে একের পর এক দেশের দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে শেষ করে দিল! আমরা সবাই চুপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে গেলাম। চেষ্টা করছে সবাই, সরকার থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা, কিন্তু সবাই জানে, অন্তত এখনো পর্যন্ত, একে হারানো যাবে না। ঠিক যেন একটা বাচ্চাকে একটা গ্লোব আর একটা স্কেচপেন নিয়ে খেলতে দেওয়া হয়েছে; যেখানে পারছে রং দিয়ে দিচ্ছে, আর রাঙানো জায়গাটা হচ্ছে ইনফেক্টেড জায়গা। কখন যে সে থামাবে নিজের প্রলয়মাতন, কেউ জানে না। শুধু তার থামার ভরসায় চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। জানো, মাঝে মাঝে ভাবি, প্রত্যেক একশো বছর অন্তর যে এই মারণরোগের প্রকোপ হয়, সংক্রমণ হয়, এটার দরকার। প্রত্যেক একশো বছরের মধ্যেই মানুষ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এই বিশ্বচরাচরের মাঝে ধূলিকণার থেকেও ক্ষুদ্র, আণুবীক্ষণিক এক জীব যে মানুষ, এটা সে বিস্মৃত হয়ে, আর তারই ফলস্বরূপ এই মহামারী। যাতে প্রত্যেক একশো বছরে মানুষকে মনে করানো যায়, যে সে কিচ্ছু না। কিচ্ছুটি না। একটা তুড়ি, সে শেষ।
এরমধ্যে কিছু লোক আবার দাবি দিচ্ছে, সব মানুষ মরে যাক, গাছপালা পশুপাখি হেঁচেকেশে বাঁচবে, রূপ খোলতাই হবে, মানুষ যাচ্ছেতাই প্রাণী, সবাইকে কেটেছেঁটে ফেলে। মানছি, আমাদের অনেক দোষ। কিন্তু সেগুলোকে ঠিক করার চেষ্টা না করে, এবং যে লোকগুলো কিছুই করেনি, উল্টে গাছপালা পশুপাখি বাঁচানোর চেষ্টা করেছে ও করছে, তাদের মেরে ফেলে কী লাভ হবে?? যদি মানুষই না থাকে, তাহলে বৌ-কথা-কও-এর গান কে শুনবে? কুমির? নাকি লজ্জাবতী লতার পাতা ছুঁয়ে দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবে একটা খ্যাঁকশিয়াল? নাকি প্রজাপতির ডানার রঙ দেখে চোখ ঝিলমিলিয়ে যাবে একটা জলহস্তির? কিছুই না, বাকস্বাধীনতার দরকার যেমন আছে, তেমন তা খর্ব করারও দরকার আছে। কিছু লোকের জিভ, পেন আর কিবোর্ড কেড়ে নিলে জগৎটারই আখেরে মঙ্গল।
এই অদ্ভুত কিসিমের জগৎ, এত হতাশা, এত রোগব্যাধি, দুরাশা, খুনোখুনির মধ্যেও, তুমি ছিলে, এবং, তুমিই আছ। অদ্ভুত এই, কালও তুমি থাকবে, হয়তো এই জগৎটাও; কিন্তু আমি হয়তো আর থাকব না। অথচ, এমনটা চাইনি, জানো। এখনই ফুরিয়ে যেতে চাইনি। অথচ, ফুরিয়ে যেতে হল। এরকম কতশত স্বপ্ন রোজ কুরবানি যায়, পতাকায় ঢেকে গানস্যালুটের বিলাসিতা ছাড়াই। কীইবা এসে গেল! কীইবা এসে যায়! কতটুকুই বা এসে যায়!
আর লিখতে পারছি না। বুকে কষ্ট হচ্ছে খুব। অক্সিজেনের লেভেল বাড়িয়ে দিল। হয়তো... আর কয়েক ঘণ্টা। তারপরেই হয়তো জানতে পারব, ওই পারের আসল কিস্যাটা আসলে কী।
ভালো থেকো। ভালোবাসা নিয়ো। নিজের যত্ন নিয়ো। বাবামাকে ভালো রেখো, দেখে রেখো।
ইতি,
উহান(মানে করোনা) ভাইরাসের হাজার হাজার শহিদের একজন(আগাম)।
Comments
Post a Comment